২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, ব্যাংক লুটপাট প্রভৃতি নিয়েই। অর্থনীতিবিদদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে কিছু পচন ঠেকাতে সফল হয়েছে, কিন্তু লুটপাটের জের শিগগির মিলিয়ে যাচ্ছে না। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কারণ, লুকিয়ে রাখা মন্দ ঋণ প্রকাশ্য হবে। ডলারের দাম কোথায় স্থির হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। আর মূল্যস্ফীতিতে দ্রুত লাগাম টানা যাবে–এমন আশা কম।
গত ১৮ নভেম্বর দেওয়া এক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিষণ্ন চিত্রই উপস্থাপন করেছে। সরকারের ঋণমানের অবনমন করে মুডিস বলেছে, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্তত তিনটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। এগুলো হলো কম রাজস্ব আয়, বহিস্থ খাতের দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতসংক্রান্ত ঝুঁকি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা হলেও আশাবাদী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে, জুনে শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশের তলানিতে নামলেও পরের অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠবে। মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ শতাংশে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির উত্থান আর মূল্যস্ফীতি পতনের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘটনা আগামী বছর থেকেই ঘটতে শুরু করবে। তবে আমূল সংস্কার না করতে পারলে নতুন বছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মধ্যে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদও আছে। ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থনীতি হয়তো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে না, তবে প্রবৃদ্ধির ধারায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি এ বছরই শুরু করতে হবে। আর সে জন্য অন্তত ১১টি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এর মধ্যে রয়েছে, আর্থিক খাতে সংস্কার শেষ করা, মূল্যস্ফীতির রাশ টানা, রাজস্ব খাতের সংস্কার, বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবস্থা, শিল্পের নিরাপত্তা, জ্বালানি ও পরিষেবা, কৃষি খাত চাঙা করা, শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, সুশাসন নিশ্চিত করা, এবং কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে টাকা ছাপানোর যন্ত্র আছে। কিন্তু সরকার চাইলেই ইচ্ছেমতো টাকা ছাপায় না। কারণ তাহলে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে। এতে টাকার মূল্য কমে যাবে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। বেশি দামে কিনতে হবে জিনিসপত্র। কিন্তু এরপরও নিরেট অর্থনৈতিক নীতির বাইরে গিয়েও সরকার টাকা ছাপিয়ে থাকে। এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকার টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করেছে। শেষ সময়ে এসেও তারা টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করেছে। অর্থ উপদেষ্টা সমপ্রতি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছাপিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারও সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বিভিন্ন ব্যাংককে সহায়তা দিয়েছে। যার মূল কারণ ঐসব ব্যাংকে তারল্য সংকট বা টাকার সংকট।
মূলত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারার পরিস্থিতিতে পড়া ৬টি ব্যাংককে বাঁচাতে টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে লেনদেন চালিয়ে নিতে পারলেও অধিকাংশ ব্যাংকই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। ফলে নতুন বছরেও এই সংকট চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে বলেই মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাহলে করণীয় কী? এমন প্রশ্নে ‘পুঁজি পুনর্গঠনে‘ সহায়তার পরামর্শ দিলেন তিনি। বলেছেন, ‘এসব ব্যাংকের জন্য আরও অনেক বেশি পুঁজি পুনর্গঠনের প্রয়োজন পড়বে। তাদের যদি পর্যাপ্ত পুঁজির ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে কিছুই হবে না। সেই পুঁজিটা এভাবে হতে পারে যে, তাদের যেসব ঋণ আছে সেটা যদি কেউ কিনে নেয়, অথবা তাদের যদি বন্ড ইস্যু করার সুযোগ দেয় অথবা যদি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে যদি ব্যাংকগুলোকে আরেকটু শক্তিশালী করা যায় তাহলে সেটা কাজে লাগবে।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো এর আগেই সরকার যে তারল্য সহায়তা দিয়েছে সেটা কেন ব্যাংকগুলো কাজে লাগাতে পারলো না? এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বরং আরও সহায়তা চাওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নানা পদক্ষেপের কথা বলছেন। তবে নিরেট এসব অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দিয়েই যে অর্থনীতির চাকা ভালোভাবে সামনের দিকে ঘুরতে থাকবে, তেমনটা নাও হতে পারে। বিশেষ করে জনমনে অসন্তোষ কিংবা দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চিয়তা থাকলে অর্থনীতির পথও কঠিন হয়ে যায়; বাংলাদেশের সংকটটা সেখানেই। মোট কথা হলো, অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মোকাবেলা করতে হবে। অর্থনীতি নিয়ে যে উদ্বেগ বিরাজ করছে, তা কাটাতে হবে।