বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালীন স্থবির হওয়া অর্থনীতি চাঙা আর জীবন ও জীবিকা রক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল জাতীয় সংসদে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন করোনা সংকট কেটে গিয়ে দেশের অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে স্বমহিমায়।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতির এই পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬.২ শতাংশের মত। গত এক যুগে সরকার ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করলেও মহামারীর সঙ্কটে প্রণোদনার টাকা যোগানোর চাপ থাকায় গতবার তা ৬.১ শতাংশে পৌঁছায়। এবার তা আরও বড় হল। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে ধার করে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। সরকার বিদেশি সাহায্য ও বিদেশি ঋণ নিয়ে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ধার করে, জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে। এবারের বাজেটের ছয় লাখ কোটি টাকা খরচ করতে হলে এর এক তৃতীয়াংশই ঋণ করতে হবে। সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে। এছাড়া বাজেটে সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। তা সত্ত্বেও মহামারীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এ বাজেটকে মানুষের জীবন-জীবিকা বাাঁচিয়ে অর্থনীতি জাগানোর চ্যালেঞ্জ হিসাবে বর্ণনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে প্রথমবারের মত সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরেও প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় মানুষের সহায়তায় বাড়তি নজর দেওয়ার অংশ হিসেবে এই খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কারও ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা নেই। তবে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণত প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়।
এবারের বাজেটের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। করোনা মহামারির জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ। অর্থমন্ত্রীর ১৫৮ পাতার বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। জমানো পুঁজি ভেঙে খেয়েছে সাধারণ মানুষ। মোট কথা বিশ্বময় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরেও সকল সংকট মোকাবিলা করে দেশের জিডিপি বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের মাথাপিছু গড় আয়। এগুলো নিসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। এই সমৃদ্ধিকে পুঁজি করে মাথা উচু করে বিশ্ব দরবারে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান বাড়ানো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে। এ জন্য বাজেটে দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও করপোরেট করে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটে মেডিকেল যন্ত্রাংশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সংসদ অধিবেশনে নতুন অর্থবছরের জন্য এই বাজেট পেশ করেন। এটি শেখ হাসিনা সরকারের বর্তমান মেয়াদের তৃতীয় বাজেট। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালেরও তৃতীয় , আওয়ামী লীগ সরকারের ২১তম এবং বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট । এর আগে জাতীয় সংসদের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে বাজেট প্রস্তাব পাশের অনুমোদন দেওয়া হয় । এরপর আগামী অর্থবছরের এই বাজেটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ স্বাক্ষর করেন। বাজেট উপস্থাপনের শুরুতেই ১৯৭১ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয় অডিও ভিজ্যুয়ালে।
আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এডিপি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন করা হয়েছে। সরকার আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অনুমোদিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মোট ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে এডিপির আওতায় প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৪২৬টি। এ ছাড়াও স্বায়ত্বশাসিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের সংখ্যা ৮৯টি।