অর্থনীতি ও সম্ভাবনার আরেক দিগন্ত

খেজুর গাছ

বাসুদেব খাস্তগীর | শনিবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এক গাছের নাম খেজুর গাছ। এক সময় গ্রামের পথে ঘাটে জমির ধারে যে পরিমাণ খেজুর গাছ চোখে পড়তো, তা এখন চোখে পড়ে না বলেই চলে। আমাদের দেশের কিছু কিছু এলাকায় এখনো এই খেজুর গাছ ব্যাপকভাবে দেখা গেলেও কোনো কোনো জায়গা থেকে একেবারে বিলুপ্তির পথে। আমাদের গ্রাম বাংলার শীতকালে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর অন্যতম উপকরণ হচ্ছে খেজুরের রস। এই খেজুরের রস থেকেই তৈরি হয় মজাদার এক ধরনের খেজুরের গুড়। এ জন্য শীতকাল এলেই খেজুর গাছ আমাদের সবার নজরে আসে এবং খেজুর গাছের গুরুত্ব বেড়ে যায়। বছরের অন্য সময়ে খেজুর গাছ তেমন আলোচনায় থাকে না। আবহমান এ বাংলার একটি ঐতিহ্য হচ্ছে শীতকালীন পিঠা। নানা রকম বাহারি পিঠা আমাদের বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য। এ রকম ঐতিহ্যমণ্ডিত বাহারি পিঠার সমারোহ পৃথিবীতে দুষ্কর। সারা পৃথিবীতে বাঙালির এ পিঠার সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে শীতকালে মহাসমারোহে পিঠা উৎসবের আয়োজন করতে দেখা যায়। গ্রামে একসময় দেখা যেতো শীতকালে কলসিতে করে খেজুরের রস বিক্রি করতো রস বিক্রেতেরা। এখন এরকম দৃশ্য যেন বড়ই দুর্লভ। শহরে জন্মগ্রহণ করা বা বেড়ে উঠা শিশুকিশোরদের অনেকেই হয়তো খেজুর গাছকে চোখেই দেখেনি। বইয়ের পাতায় ছবি দেখে খেজুর গাছকে কল্পনায় ভেবে থাকে। শুধু গ্রাম নয় শহরের মানুষের কাছেও খেজুরের রস ও গুড় ভীষণ প্রিয় একটি খাবার। আবহমান বাংলার এই ঐতিহ্যের খাবারকে প্রসার করতে হলে কিংবা এর বাণিজ্যিকীকরণ করতে হলে খেজুর গাছেরও প্রসারতা বাড়াতে হবে। সরকারের কৃষি বিভাগ নিতে পারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। খেজুর গাছ নিয়েও হতে পারে নানামুখী গবেষণা। যে সমস্ত জায়গায় খেজুর গাছ রয়েছে সারা বছর এগুলো অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে, আর শীতকাল আসলেই এর পরিচর্যা শুরু হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভিত্তিতে এর চিন্তা ভাবনা করা গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে খেজুর গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যথাযথ গবেষণায় মাধ্যমে খেজুরের পাতা ও খেজুরের রস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। বাঙালির পিঠার সাথে খেজুরের রয়েছে এপিঠ ওপিঠ সম্পর্ক। একটি ছাড়া যেন অন্যটি কল্পনাই করা যায় না। শীতকালে গ্রামবাংলা বা নগর জীবনে শীতের পিঠা দিয়ে খেজুরের আপ্যায়ন অন্য এক আভিজাত্য বহন করে। এই খেজুর গাছের সাথে শুধু রস নয় খেজুরও একটি সুস্বাদু খাদ্য। অন্যান্য ফলের পাশাপাশি খেজুরের চাহিদাও কম নয়। খেজুরের বাণিজ্যিকীকরণের চিন্তা ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হলে এর ফল ইতিবাচক হতে পারে। খেজুর গাছের ফল খেজুরে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, খেজুরে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি, ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেলযা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। আর খেজুরে প্রোটিনও রয়েছে প্রচুর। তাই খেজুর আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। এ প্রোটিন আমাদের পেশী গঠনে সহায়ক। ভিটামিন এ, বি, সি ও কে খেজুরে পাওয়া যায়। এগুলো চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে, দেহে শক্তি যোগাতে কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। খেজুরে খনিজ, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও পটাশিয়াম, অ্যান্টিঅঙিডেন্ট, ম্যাগনেশিয়াও রয়েছে। তাই বলা হয় খেজুর রক্তে হিমোাগ্লোবিন বাড়ায়, হাড় শক্ত করে, হৃদযন্ত্র সচল রাখে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হজমে সাহায্য করে, ওজন নিয়ন্ত্রণ সহায়তা করে ও ক্ষুধা কমায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, খেজুরে ক্যালোরি ও ফ্যাট এর প্রভাব কম বিধায় শরীরে এর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। খেজুরে যে চিনি থাকে তা প্রাকৃতিক। এতে গ্লোকোজ, ফ্রুকটোজ এবং সুক্রোজ থাকে। এ জন্য চিনিগুলি শরীরকে তাড়াতাড়ি এনার্জি দেয়। এ জন্য পরিশ্রমের পর খেজুর খেলে শক্তি ফিরে আসে। ফলে ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীরকে দ্রুত সতেজ করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে খেজুরের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। এই খেজুর গাছ আমাদের অন্যান্য ফলজ গাছের মত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রোপণ, বাগান তৈরি বা ব্যক্তি পর্যায়ে প্রণোদনা দিয়ে রোপণ করলে নতুন এক বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। শুধু শীতকাল আসলেই খেজুর গাছের বিষয়টি সামনে আসে, কিন্তু অন্যসময় তা সকলের দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে যায়। গ্রামে আমাদের যাদের ছেলেবেলা কেটেছে তাদের এই খেজুর গাছ নিয়ে অনেকেরই অম্লমধুর স্মৃতি আছে। শীতকাল আসলেই রাস্তার দুপাশে সারিসারি খেজুর গাছে গাছের মালিকরা গাছের ঢাল ছেঁটে কী সুন্দর করে রস পড়ার ক্ষেত্র তৈরি করে নিতো। খেজুর গাছ ছাঁটার লোককে গাছি বলা হতো। প্রতিবছর রস পড়ার জায়গাটি কাটতো বলে খেজুর গাছটি কাটা কাটা এক ধরনের সিঁড়ি বা তাকের রূপ গ্রহণ করতো। চুরি হয়ে যাবার ভয়ে অনেক গাছি রাত জেগে রসের হাঁড়ি পাহারা দিতো। গ্রামের অনেক শিশুকিশোর খেজুর গাছের ঢাল দিয়ে নানা খেলনা বানিয়ে খেলায় মেতে থাকতো। এগুলো আবহমান গ্রাম বাংলার বাস্তবতারই চিত্র। পরিবেশ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদেশের মাটি মোটামুটি খেজুর গাছের জন্য উপযোগী। কিন্তু নানা অযত্ন অবহেলা, তদারকি কিংবা এ নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা না থাকার কারণে এ বৃক্ষও দেশের অনেক জায়গা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু কৃষিবিদ গবেষণা করে দেখিয়েছেন, একজন গাছি প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত গাছ কাটতে পারেন, যা থেকে ৩০৩৫ মণ গুড় তৈরি হতে পারে। খেজুর গাছের পাতা দিয়ে এক ধরনের পাটিও তৈরি করা যায়। সুতরাং কুটির শিল্পের উপকরণ হিসেবেও খেজুর গাছের গুরুত্ব আছে। খেজুর গাছ সীমানার বেড়া, মাটিক্ষয় রোধে ও জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। আয়ুর্বেদী ওষুধ তৈরিতেও খেজুর, খেজুরের রস, মাথি এবং গাছের শিকড় ব্যবহার করা যেতে পারে। খেজুর গাছের প্রসার হলেই খেজুর সংশ্লিষ্ট রস, গুড়সহ এর বহুমুখী সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। এ গাছ রোপণের একটি বিশেষ হংবিধা হলো এর জন্য আলাদা কোনো চাষের জমির প্রয়োজন হয় না। এখন গ্রাম বাংলায় যে দৃশ্য আমরা দেখছি তাতে দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া খেজুর গাছের স্থলে আর কেউ নতুন করে এ গাছ রোপণ করেন না। বিষয়টাকে প্রচার প্রচারণা এবং এর রস, গুড়, ভিটামিন সমৃদ্ধতা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনাগুলো সামনে নিয়ে আসলে এটি আবার হয়তো আমাদের দৃষ্টিতেই ফিরে আসবে। প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। অর্থনীতিতে অন্তরালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য থাকে, যা অনেকের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না, কিন্তু তাকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দিলে তা হতে পারে দেশের অর্থনীতির শক্তি। খেজুর গাছের বাণিজ্যিকীকরণ চিন্তাভাবনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে।

লেখক

প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাহিত্য চর্চায় সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে