বাংলাদেশের অর্থনীতিতে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও অর্থনীতির ক্ষতগুলো সারাতে সামনের দিনগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর কৌশল নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বহুমুখী বলে তুলে ধরে সিপিডি তিন ধাপে পরিকল্পনা করারও পরামর্শ দিয়েছে।
দেশের অর্থনীতির চলামান অবস্থা তুলে ধরতে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪–২৫, সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি এমন পরামর্শ দিয়েছে। গতকাল বুধবার সংস্থাটির রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতির পুঞ্জীভূত সমস্যা গত ১৫ বছরে কোন পর্যায়ে গিয়েছে সেটি তুলে ধরা হয়। এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই মাসের সফল আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছে সিপিডি। খবর বিডিনিউজের।
আগের সরকারের সময়ে অর্থনীতি দুর্বল ছিল বলে মন্তব্য করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সামনের দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সংস্কারের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর কৌশল নিতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলগুলো এমন হবে যে, অর্থনীতির তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করবে। পরবর্তী যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের জন্য মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কারের সূচনা করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পূঁঞ্জীভূত সমস্যা তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি উচ্চ চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্বল রাজস্ব আহরণের ফলে আর্থিক সংকুলান না হওয়া, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের অত্যাধিক নির্ভরতা, জ্বালানি তেলের সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ইত্যাদি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে একটি নেতিবাচক অবস্থা নিয়ে গেছে।
অর্থনীতির এই চ্যালেঞ্জগুলো বহুমুখী মন্তব্য করে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থ্যানের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনীতির এই বহুমুখী সমস্যাগুলোতে নজর দিতে হবে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা।
এই বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন ফাহমিদা খাতুন। তিনটি ধাপে পরিকল্পনাটি করা যেতে পারে বলে পরামর্শ এসেছে তার কাছ থেকে। এর মধ্য প্রথম পর্যায়ে জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন ফাহমিদা খাতুন। দ্বিতীয় ধাপে অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে টেকসই সংস্কার বাস্তবায়ন করা এবং চলমান রাখা। তৃতীয় পর্যায়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা, প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সুরক্ষায় একটি সমন্বিত পদ্ধতি দরকার বলে তুলে ধরেন তিনি।
নিত্যপণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল ও পাম তেলসহ ১৪টি প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরেছে সিপিডি। সেই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, দামের ওঠানামা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ কৃষিপণ্যে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া রয়েছে। সড়কে চাঁদাবাজি পুরোটা এখনো নিয়ন্ত্রণ না হওয়াও মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিনিয়োগ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ীদের মধ্যে থাকাটা স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, নির্বাচনের যে টাইমলাইন দেওয়া হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাওয়াটা জরুরি।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে বৈপরীত্য নেই মন্তব্য করে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, শুধু নির্বাচনী সংস্কার দিয়ে হবে না। যত দ্রুত সম্ভব একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এজন্য একটি সমঝোতায় আসতে হবে সকলকে। যাতে আর্থিক খাতের সংস্কারগুলো অব্যাহত থাকে।
বেশিরভাগ ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেছে, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রকৃতপক্ষে খেলাপী ঋণের অঙ্কটা আরো বেশি। এসব ব্যাংকের অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা নেই। মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লাইফ সাপোর্টে রাখা ব্যাংক বন্ধ করা যেতে পারে।
ইচ্ছেকৃত খেলাপীদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ, বিকল্প আইনি উপায়ে সমাধান ও ব্যাংকের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করেন ফাহমিদা খাতুন। বড় বড় ঋণে কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার, নীতি ছাড় ও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নরের মধ্যে কয়েকজনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি করেন ফাহমিদা খাতুন। এছাড়া রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত প্রকাশ, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিএফআইইউকে (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) শক্তিশালী করার কথা বলেছেন তিনি।