বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে প্রতিটি খাতে দেখা দিয়েছে সংকটের ছায়া। ব্যাংক খাতের মারাত্মক তারল্য সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভে চাপ এবং জ্বালানি সংকট মিলিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের কঠোর শর্ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ নীতিগত দুর্বলতা। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো– দেশের বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রফতানি কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক ভূ–রাজনৈতিক অস্থিরতা– সব মিলিয়ে এক কঠিন সময় পার করছে গার্মেন্ট খাত। সংকট কাটাতে সরকারি সহায়তার ঘাটতির পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা ও উদ্বেগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী গত বছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ, যা এ বছর কমে দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। অর্থাৎ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ শতাংশ। বিষয়টি এরই মধ্যে গণমাধ্যমেও প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন, তারা অবশ্যই এ অর্থের উৎস অনুসন্ধান করবেন এবং দায়ীদের আইনের আওতায় আনবেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। ফলে সুদহার বেড়েছে, যা বেসরকারি খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যবসা সমপ্রসারণ করতে পারছেন না। বর্তমানে ব্যাংক ঋণপ্রবাহ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ শতাংশে। শিল্পায়নের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ট্রেডিংকেন্দ্রিক অর্থনীতি হওয়ায় দেশে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। গত বছর ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমেছিল, আর এ বছর তা আরো কমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পায়নের এ নিম্নগতির কারণে গত এক বছরে চাকরি হারিয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। যারা একসময় কোথাও কর্মরত ছিলেন, তারা এখন জীবিকার সংস্থান না করতে পেরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার সরকারি বা আধা–সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান, প্রায় আট লাখ বিদেশে যান এবং প্রায় ১০ লাখ বেসরকারি খাতে কাজ পান। বাকিরা বেকার থাকেন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় বেকারত্ব দ্রুত বাড়ছে।
তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুদের হার বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সঙ্কটে ধুঁকছে শিল্প খাত। ভারী শিল্পের উৎপাদন, চাহিদা ও বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমায় মুনাফায়ও প্রভাব পড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন করে উৎপাদন ও আমদানিতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৪ কোটি টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় তা ৪ শতাংশ বেড়েছে সত্যি; কিন্তু শিল্প খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভারী কাঁচামালের আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এর কারণ এক দিকে অব্যাহত জ্বালানি সঙ্কট, অন্য দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পে গতি ফেরাতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ব্যবসায়িক আস্থার পুনরুদ্ধার, আমদানি–রফতানির ভারসাম্য রক্ষা এবং জ্বালানি সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং নগরায়ণ পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অর্থনীতিতে শিল্প খাতকে গুরুত্ব না দিলে দেশ কখনো অর্থনৈতিকভাবে মজবুতি লাভ করতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন। স্থল, নৌ এবং বিমানবন্দরসহ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা করা এবং বেসরকারি খাতে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় খাতে যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।








