বেশিরভাগ নারীদের পরনে অরেঞ্জ কালারের পোশাক। নানা প্রতিবাদী স্লোগান, তাও অরেঞ্জ কালারের ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড হাতে, বিগত বছরগুলোতে প্রত্যেকের হাতে থাকতো দু’একটি কমলা। আর র্যালি করার সময় এই কমলা পথের রিকশাচালক, ভ্যান গাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে বিলি করা হতো সাধারণ পথচারীদের মাঝে। স্লোগানে স্লোগানে মুখর থাকতেন অরেঞ্জ পোশাকে সজ্জিত নারীরা। দেশের এই সংকট আর দুর্যোগকালীন সময়েও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। জোন্টা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব চিটাগাং এবং ১০ টি ইনার হুইল ক্লাব এবং লেডিস ক্লাবের সমন্বয়ে অত্যন্ত আন্তরিক আয়োজনে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ দিবস। জোন্টার আন্তর্জাতিক নেত্রী মমতা গুপ্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জোন্টা ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল চিটাগাং–এর পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট চেয়ারপারসন দিলরুবা আহমেদ খুব স্বল্প সময়ে এই দিবস পালনোপলক্ষে চমৎকার এই ক্যাম্পেইন সম্পন্ন করেন। এই আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে দিলরুবা আহমেদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমরাও দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে নারী নির্যাতনে জিরো টলারেন্স নীতিতে আসতে চাই। যারা নির্যাতিত হয়, তারা বিচার চাইতেও পারে না, কারণ সেই সক্ষমতা এবং সাহস তাদের নেই। আমাদের নারী সংগঠনগুলোকে তাদের পাশে থেকে কঠোর আওয়াজ তুলতে হবে, তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই ক্যাম্পেইনকে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষে এবং যেসব নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না, তাদেরকেই সচেতন করে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রথমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে সমাজ থেকে সকল প্রকার বৈষম্য নির্মূল করা। জানতে চাইলে জোন্টা নেত্রী এবং ইনার হুইল ক্লাব চেয়ারম্যান ফারাহ নাজ কাইয়ুম বলেন,আমরা পক্ষকাল ব্যাপী এই কর্মসূচিতে প্রতিদিনই এক একটি ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়ে কাজ করি। যাতে আমরা নারী পুরুষ বৈষম্যকে দূর করতে পারি। সমাজ থেকে নারী ও শিশুর প্রতি যেন সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারি। তবে তা এক দিনেই সম্ভব না। ধীরে ধীরেই সফলতা আসবে। আসবে সচেতনতা। লেডিস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খালেদা আউয়াল বলেন, আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি সমাজের অবহেলিত মানুষগুলোকে সচেতন করা যায় তবেই সম্ভব হবে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসের মধ্য দিয়ে একটি বৃহৎ অথচ অত্যন্ত কঠিন এই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। তিনি এই বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তারা ও স্ব স্ব অবস্থান থেকে নারী পুরুষের বৈষম্য ও নারী ও শিশু নির্যাতনের ইতিহাস, ধরন, আইনি বিষয়, মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেন। মঞ্চে সব কমলা পোশাকে আলোকিত নারী, একটি মাত্র পুরুষ সোশ্যাল এক্টিভিস্ট নোমান উল্লাহ বাহার, আর অডিয়েন্সে কমলা পোশাকে সজ্জিত সুন্দর মনের নারীকুল সেদিন অরেঞ্জ ওয়ার্ল্ড ডে তে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কমলা রং–এর যে উজ্ঝলতা রয়েছে, রসনা বিলাসেও ফলটির জুড়ি মেলা ভার। তাই মিষ্টি এই ফলের উজ্জ্বলতার মতোই প্রতিটি নারীর জীবন যেনো বিকশিত হয় সেই প্রত্যাশা এবং চাওয়া ছিল উপস্থিত নারীদের কথাবার্তায় আর সাজসজ্জায়। রাজধানীতে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় দিবস টিকে বিশেষভাবে পালন করে। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ বলেন, দেশের ৪০ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার। আমাদেরকে এই সহিংসতা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। নজরদারী দিতে হবে এবং বিষয়টাকে গবেষণার আওতায় এনে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতামুক্ত দেশ গড়তে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে সততা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। মূলত: ১৯৬০ সালে ল্যাটিন আমেরিকায় ডোমিনিজ্যাল রিপাবলিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে একটি যুক্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময় প্যাট্রিয়,মারিয়া তেরেসা এবং মিনার্ভা মিনারেল নামের একই পরিবারের তিন বোনকে হত্যা করা হয়। তবে এই ঘটনার বাদ প্রতিবাদ হলেও ১৯৮১ সাল থেকেই দিবসটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিবসটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পক্ষকালব্যাপী পালনের আহ্বান জানান। আমাদের দেশে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ইয়াসমিন নামের দিনাজপুরে এর এক কিশোরী গৃহকর্মীকে কতিপয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য রাতের আঁধারে তাকে নিরপত্তা দেয়ার কথা বলে তাদের টহল পিক আপে তুলে নিয়ে প্রথমে ধর্ষণ করে, পরে হত্যা করে লাশ রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। ভোরে ঘটনা জানাজানি হলে বিক্ষোভে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দিনাজপুরবাসী। তুমুল আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীনেত্রীরা গিয়ে মিছিলে প্রতিবাদে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনেক চেষ্টা করেও প্রশাসন এই ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারেনি। মামলা হয়; অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট মামলার রায় হয় এবং দীর্ঘ ৮ বছর পর ২০০৪ সালে আসামীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এর আরো আগে নীহার বানু হত্যা, শারমীন রীমা হত্যা,ফাহিমা, মহিমাসহ অনেক হত্যাকাণ্ড দেশে নারী নির্যাতনের কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। শুধুমাত্র পশুরূপী কিছু মানুষের যৌন লালসার শিকারে এসব নিরপরাধ নারীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে। এখন বিশ্ব এগিয়েছে। আমাদের দেশও থেমে নেই একই জায়গায়। সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ব এখন প্রতিটি নারী পুরুষের হাতের মুঠোয়। তবে এখনো রয়েছে সচেতনতার অভাব, আর রিপুর প্রাবল্য। কাজেই একটু সচেতন হয়ে, যারা অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্বল আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই। সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতনকে রুখে দেই।