অরুণদা

জ্যোতির্ময় নন্দী | শুক্রবার , ২৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১এর আগে আমি অরুণদার মামা পরিমল সেনকে খুব চিনতাম, কিন্তু অরুণদাকে চেনা দূরে থাক চোখের দেখাও কখনো দেখিনি। দেখবো কী করে? তখন তো তিনি কলকাতায়। কলকাতা আর বিশ্বভারতীতে শিক্ষাজীবন শেষ করে পার্টির নির্দেশে লক্ষ্মীকান্তপুরে না কোথায় কোন হাই স্কুলে মাস্টারি করছেন। কলকাতা থেকে লোকাল ট্রেনে যাওয়া আসা করেন। কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। পুরো বোহেমিয়ান জীবন।

কলকাতাতেই তাঁর দীক্ষা হয় বামপন্থী রাজনীতিতে। তাঁর কাকা দীনেশ দাশগুপ্ত কংগ্রেসী রাজনীতি করার সুবাদে ঘরে রাজনীতির আবহাওয়া আগে থেকেই ছিল। কিন্তু অরুণ দাশগুপ্ত সেই চলতি হাওয়ার পন্থী না হয়ে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে।

একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এলেন, কিসের টানে জানি না। এসে কিছুদিন মফস্বলের দুটো স্কুলে অল্পদিন শিক্ষকতা করার পর সম্ভবত ১৯৭৩ নাকি ’৭৪এর দিকে আজাদীতে যোগ দিলেন। আমি তখন ১৭১৮ বছরের তরুণ। সেই সময়েই তাঁকে আমি প্রথম দেখি কলকাতাফেরত সাংস্কৃতিক মুক্তিযোদ্ধা কিছু তরুণতরুণীর একটি সংগঠন ‘বঙ্গশ্রী শিল্পী সংসদ’এর একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। শুনলাম, তিনি সাংবাদিকআজাদী পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক। দেখলাম, ৩৫৩৬ বছরের একজন ছিপছিপে শ্যামলকান্তি যুবক, যিনি সবার উপরে নিজের হাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঈষদ আনুনাসিক সুরে, খানিকটা যেন মেয়েলি ঢঙে, কিন্তু সুরতালের পুরো শুদ্ধতা রক্ষা করে গোটা দুই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। আমার তেমন ভালো লাগল না। আমি তখন পঙ্কজ কুমার, হেমন্ত, দেবব্রত প্রমুখের পুরুষালি কণ্ঠের রবীন্দ্রগানের অন্ধ ভক্ত। অরুণদার গান আমার পছন্দ হয়নি। পরে জেনেছি, অরুণদা কলকাতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন সঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার আর শুভ গুহঠাকুরতার কাছে। আরো পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছি, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার এই আদি ধারা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, দীনেন্দ্রনাথ, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন, সুবিনয় রায় প্রমুখের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, এবং অরুণদা ছিলেন এ ধারারই অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীত নিয়ে অরুণ দাশগুপ্তের বহুদিনের চর্যা, অনুশীলন, পঠন পাঠন, চিন্তনের কিঞ্চিন্মাত্র প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য’ গ্রন্থে। বাকি কিছু লুকিয়ে আছে কোনো অপ্রকাশিত লেখায়, অথবা মহাশূন্যে হারিয়ে গেছে চিরতরে।

তখনও কিন্তু আমি জানতাম না, তিনি পরিমল জ্যাঠার ভাগ্নে। পরে দিনে দিনে, ধীরে ধীরে তাঁকে জানার পরিধি বিস্তৃততর হল। আমি তাঁর অসংখ্য স্নেহধন্য তরুণদের একজন হয়ে উঠলাম। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার মাধ্যমটি ছিল কবিতা। সম্ভবত ১৯৭৯ কি ’৮০’র দিকে আমি তাঁকে আমার একটা কবিতা দিই, আজাদীর সাহিত্য পাতায় ছাপানোর জন্যে। মোটেই দুরুদুরু বক্ষে দিইনিকারণ ততদিনে আমার কবিতা সিনিয়রদের কাছ থেকে বিস্তর প্রশংসাসূচক পিঠ চাপড়ানি পেয়েছি, এবং আমার কবিতা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, লিফলেট ইত্যাদিতে ছাপা হওয়া শুরু হয়েছিল। কাজেই কবিতাটা অরুণদার হাতে দেওয়ার সময় আমার মনের ভাবটা ছিল ‘এটা বাপু খুবই ভালো একটা কবিতা, না ছাপালে তোমাকে দেখে নেব’ গোছের। অরুণদা কিন্তু সুগন্ধি জর্দা দেয়া মিঠাপান চিবোতে চিবোতে একটু হেসে, ঠোঁটের কোণা থেকে পানের রস মুছে আলগোছে কবিতাটা নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন, আর তারপর আমাকে যথারীতি পাশের লাকি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে গরম চা শিঙাড়া জিলাপি খাইয়ে বিদায় করলেন।

অরুণদার কাছে যেই যাক, তাকে চা সন্দেশ, সিঙাড়া, জিলাপি ইত্যাদি খাইয়ে আপ্যায়িত করা ছিল তাঁর অবধারিত রীতি। লাকি হোটেলের সঙ্গে ছিল তাঁর মাসকাবারি ব্যবস্থা। কথা ছিল, ওরা যাবতীয় বিল খাতায় টুকে রাখবে, আর অরুণদা মাসশেষে তা একবারে শোধ করবেন। ওরা পাঁচকে সাত আর সাতকে সতেরো করে বাড়িয়ে টুকে রাখত, আর অরুণদা চোখ বুঁজে তা শোধ করে দিতেন। এভাবে লাকি হোটেল তাঁর কত টাকা খেয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ডা. কেশব গুপ্তের বাসায় অরুণদার সেই আস্তানা আর লাকি হোটেলদুইই আজ চাপা পড়ে গেছে নবনির্মিত বহুতল ভবনের তলায়। কালপ্রবাহে হারিয়ে গেছে আমাদের তারুণ্যযৌবনের উজ্জ্বল এক স্মৃতি।

যাই হোক, অরুণদা সেসপ্তাহেই আজাদীর সাহিত্য পাতায় আমার কবিতাটি ছাপিয়েছিলেন, এবং বড় পত্রিকায় সেটাই ছিল আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এভাবে অরুণ দাশগুপ্ত কত নবীন কবির প্রথম কবিতাকে প্রকাশনার আলোর মুখ দেখিয়েছেন, তা গবেষণার বিষয় বটে। শুধু কবিতা প্রকাশ নয়, তাদের কাব্যকবিতার লিখিত আলোচনাসমালোচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ছাপানোতে তাঁর কোনো কার্পণ্য ছিল না। মনে আছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন আমি, বর্তমানে প্রয়াত কবি শাহিদ আনোয়ার, কবি ওমর কায়সার, কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী আর কবি ইব্রাহিম আজাদএই পাঁচজনের প্রত্যেকের দশটা করে মোট পঞ্চাশটা কবিতা নিয়ে ‘ দ্রৌপদীর প্র্রেমিকেরা’ নামের কবিতা সঙ্কলনটি বেরোল, তখন চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের কাব্য জগতে বেশ একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল, আর অরুণদা এই তরুণ পঞ্চকবিকে স্বাগত জানিয়ে আজাদীর পুরো একটা পৃষ্ঠা জুড়ে বইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করেছিলেন।

পরে ১৯৮৩তে স্বয়ং সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাকে আজাদীতে সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করার জন্যে নেয়ার পর অরুণদাকে আমার সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছিলাম। আজাদীতে তখন নক্ষত্রমন্ডলীর সমাবেশ। নিউজ টেবিলে যাঁদের সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বার্তা সম্পাদক সাধন ধর, সিনিয়র সহসম্পাদক বিমলেন্দু বড়ুয়া, মোহাম্মদ ইউসুফ, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, সমীর ভট্টাচার্য, মোস্তফা কামাল পাশা, এবং দা লাস্ট বাট নট দা লিস্ট অরুণ দাশগুপ্ত। অরুণদা তখন সাহিত্য পাতা সম্পাদনার পাশাপাশি বার্তা কক্ষেও কাজ করতেন। রাতের শিফটে কাজের চাপ বেশি থাকলে পত্রিকাটির স্বনামধন্য সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ নিজেও এসে নিউজ টেবিলে বসতেন। সাংবাদিকতা যতটুকু করেছি, তার প্রাথমিক পাঠ পেয়েছি এসব মহারথীদের কাছেই, অরুণদা যাঁদের মধ্যে অন্যতম শুধু নন, অগ্রগণ্যও।

অরুণদা নিজে গান গাইতেন, কিন্তু নিজেকে কখনো গায়ক বলে স্বীকার করতেন না। কবিতা লিখতেন, কিন্তু কখনও নিজেকে কবি বা ষাটের দশকের, সত্তর দশকের কবি এরকম কিছু বলতেন না। নতুন কবিতা লিখলে হাতের কাছে কাউকে পেলে পড়ে শোনাতেন; আমিও শুনেছি তাঁর কিছু কবিতা। কিন্তু তাঁর গান শুনে যেমন, কবিতা শুনে বা পড়েও তেমন মুগ্ধ হতে পারিনি। আসলে তাঁর সঙ্গীত ও কাব্যের অন্তর্গত সুর বোঝার পক্ষে আমার বয়সটা আর মনোভাবটা ছিল বড় অন্তরায়। উদীয়মান কবির মূঢ় অহমিকায় ‘কী হনু রে’ গোছের ভাব, দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না, ধরাকে সরা জ্ঞান করছি। এদিকে নাট্যমঞ্চে গায়ক অভিনেতা হিসেবেও তখন একটু নাম ছড়িয়েছে। অরুণদার কবিতা বা গান তখন প্যানপ্যানানির মতো মনে হত। পরে ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অন্তর্দৃষ্টিতে ক্রমপরিস্ফুট হয়ে উঠেছে অরুণ দাশগুপ্তের কবিতার তন্ময় অনুভব আর মন্ময় সৌন্দর্য।

তাঁর কবিতার বই বের করার কথা বললেই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন– ‘আমিও আবার কবিপিঁপড়েও আবার পাখি!’ শেষপর্যন্ত তাঁর জীবৎকালে তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ বেরুলোই না, যদিও জীবনের একেবারে শেষের দিকে ‘খাণ্ডবদাহন’ নামে একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেছিলেন শুনেছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অরুণ দাশগুপ্তের বহু প্রবন্ধনিবন্ধ আর কবিতা গ্রন্থাকারে প্রকাশের দায়িত্ব কে নেবে? তাঁর রক্তের কোনো উত্তরাধিকারী তো নেই! এ শহরে বা দেশে তাঁর চেতনার উত্তরাধিকারীও কি কেউ আছে?

অরুণদার চরিত্রে যে ভাবটা প্রধান ছিল, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভাষায় তার নাম ‘প্রকৃতি ভাব’; অর্থাৎ কপিলের সাংখ্য দর্শনের সেই পুরুষপ্রকৃতির বৃত্তান্ত। অরুণদার স্বভাবে কিঞ্চিত নারীসুলভ কমনীয়তা ছিল, যা পরম আদরে জড়িয়ে রাখত তাঁর সংস্পর্শে যারাই গেছে, সবাইকে। গোঁফ ফোলানো দৃঢ় পৌরুষের বহিঃপ্রকাশ তাঁর মধ্যে কখনো দেখিনি।

চট্টগ্রামী আঞ্চলিক ভাষায় স্বভাবতই একটা রুঢ় পৌরুষের প্রকাশ আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বহু প্রজন্মের চট্টগ্রামী হওয়া সত্ত্বেও চাটগেঁয়ে ভাষায় কথা বলতে তাঁকে কখনও শুনিনি। এমনকি বাড়ির ‘পুরাতন ভৃত্য’ রাইমোহনের সঙ্গেও তিনি প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন। চট্টগ্রামে জন্ম ও শৈশবসহ জীবনের দুইতৃতীয়াংশেরও বেশি সময় বাস করা সত্ত্বেও, কলকাতায় তাঁর যৌবনের শিক্ষা ও প্রাথমিক কর্মজীবনে আয়ত্ত করা বিশুদ্ধ কলকাত্তাই টানের প্রমিত বাংলায় কথা বলার অভ্যাসটা কখনও ছাড়েননি। তাঁর কথার ঢঙে কলকাতার সারস্বত জীবনের আভাস পাওয়া যেতো, যদিও তা তাঁর বাচনভঙ্গীতে একটু বাড়তি কমনীয়তা যোগ করেছিল। চট্টগ্রামের কোনো এক ছড়াকার তাঁর বাচনভঙ্গী নিয়ে একটু রসিকতার ছলে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অনুজ কবিছড়াকারপ্রাবন্ধিক অজয় দাশগুপ্ত লিখেছিল: ‘গরম গরম জিলিপি ভেজেছিস খুব তো! / বললেন অরুণ দাশগুপ্ত।’ এখানে অরুণদার কথা বলার ধরনটা অবিকল ফুটে উঠেছে।

অরুণ দাশগুপ্ত মারা যাওয়ার পর তাঁর বয়ঃকনিষ্ঠ ভক্ত অনুরাগী সহকর্মী কবিলেখকরা, যাঁদের লেখা তিনি দিনের পর দিন তাঁর পাতায় ছাপিয়ে গেছেন, তাঁর বহু সন্দেশশিঙাড়াজিলাপিচা যাদের পেটে গেছে, তাঁদের কেউ কেউ অনন্ত মহিমারোপ করে তাঁকে বৃক্ষের মগডালে তুলছে, যেহেতু বিদেহী তাঁর এখন আছড়ে পড়ে হাড়গোড় ভাঙার আশঙ্কা নেই। তাঁকে বলা হচ্ছে একাধারে কবি, দার্শনিক, গবেষক, বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, আরো বহু কিছু। এতই যদি গুণী মানুষ হন, তাহলে অরুণ দাশগুপ্ত, বা সেইসঙ্গে সিদ্দিক আহমেদ, সুচরিত চৌধুরী, ওয়াহিদুল আলমেরা বেঁচে থাকতে কেন আমাদের সরকার, বাংলা একাডেমির চোখেই পড়লেন না? বহু সুউচ্চ পাহাড়পর্বত চোখে না পড়লেও, অনেক উইয়ের ঢিবি দেখি ঠিকই তাদের প্রসন্ন নয়নে পড়ে গিয়ে বকশিস টঙ্কা, বকশিস ফুর্তি দুটোই পেয়ে যায়। এ এক গভীর রহস্য বটে!

যেটা বলছিলামহয়তো স্বভাবে প্রকৃতি ভাবটা বেশি হওয়ার কারণেই, কিংবা একধরনের উদাসীনতার ফলে, অরুণ দাশগুপ্ত জীবনে পাওয়ার অনেককিছুই পাননি, আর জন্মসূত্রে পাওয়া অনেককিছুই হারিয়েছেন। জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ার সূত্রে চট্টগ্রাম শহরে আর গ্রামাঞ্চলে তাঁদের বিস্তর জমিজিরেত ছিল, দেখভালের অভাবে যার সিংহভাগই হস্তচ্যুত হয়েছে। অরুণদা সেগুলোর দিকে কখনো ফিরেও তাকাননি। পরের বাড়ি, পরের ঘরকে নিজের করে নিয়ে একধরনের নিঃস্পৃহ নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপ্রিয় জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। তাঁর নিজের পরিবার ছিল না, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গ কখনোই ছিলেন না। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মানুষ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাঁর ঘরের দুয়ার আক্ষরিক অর্থেই সর্বক্ষণ সবার জন্যে উন্মুক্ত থাকত।

অরুণদা কেন বিয়েশাদি করলেন না, সেও এক অদ্ভুত ব্যাপার। একজন এলিজিবর ব্যাচেলরের সব গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। নারী ভক্ত অনুরাগিণীর সংখ্যাও কম ছিল না। চাইলেই তাঁদের কাউকেও জীবনসঙ্গিনী করতে পারতেন। মাসী প্রণতি সেনের মতো তাঁর জীবনেও কোনো ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী আছেএমনটাও শুনিনি। তবুও তিনি বিয়ে করলেন না। করছি করবো করেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন গদাই লস্করি চালে, হেলাফেলায়।

অরুণদার রাজনীতিক কাকা দীনেশ দাশগুপ্ত বুদ্ধিজীবী এবং সুসাহিত্যিক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। কলকাতায় গিয়ে যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই কালাধন ইনস্টিটিউশানের প্রধান শিক্ষক যিনি ছিলেন, সত্যপ্রিয় রায়, যিনি একসময় চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ফলে চট্টগ্রাম তথা চট্টগ্রামীদের সাথে তাঁর একটা পূর্বপরিচয় ছিল। শিক্ষক হিসাবে সত্যপ্রিয় বাবুর নামডাক আর চট্টগ্রামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূত্র ধরেই তাঁর বিদ্যালয়ে বালক অরুণকে ভর্তি করা হয়েছিল। এই সত্যপ্রিয় রায় পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হন। পরে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও বিশ্বভারতীতে অধ্যয়নকালে তিনি আচার্য সুকুমার সেন, কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী এবং আরো বহু মনস্বী শিক্ষক ও বিদগ্ধজনদের সংস্পর্শে আসেন। সব মিলে বিগত বিংশ শতকের ষাটের ও সত্তরের দশকের কলকাতায় শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত রাজনীতির এক পরাবলয়ে অরুণ দাশগুপ্তের যে মানসলোক ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা তিনি আমৃত্যু সযত্নে বয়ে বেড়িয়েছেনবসনেভূষণে, চলনে বলনে সর্বক্ষেত্রেই। তবে সেইসঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন জন্মসূত্রে পাওয়া কিছু চট্টগ্রামী সৌজন্য ও সংস্কৃতি। কবি ভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাস্টারদা সূর্য সেনের কিশোর সহযোদ্ধা, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুলেখক পূর্ণেন্দু দস্তিদার প্রমুখের স্মৃতিধন্য ধলঘাট গ্রামের সন্তান অরুণ দাশগুপ্ত চট্টগ্রামের একসময়কার প্রচলিত ভদ্রজনোচিত সংস্কৃতিসৌজন্যের পরাকাষ্ঠার বলতে গেলে শেষ প্র্রতিভূ হিসেবেই জীবন কাটিয়ে গেছেন।

অরুণ দাশগুপ্তকে আমি যতটুকু দেখেছি, জেনেছি, তাতে তাঁকে আমার একজন কবি, দার্শনিক ইত্যাদির চেয়ে বরং প্রবলভাবে মানবঘনিষ্ঠ, মানবিক গুণাবলীতে ভরপুর একজন পরিপূর্ণ মানুষ বলেই মনে হয়েছে। অর্থসম্পদ, নারীবাড়িগাড়ি, নামযশ কিছুই অরুণ দাশগুপ্তের কাম্য ছিল বলে মনে হয় না। তাঁকে শুধু আমার মানুষের অক্লান্ত সঙ্গপিপাসুই মনে হয়েছে। এমন অহোরাত্র মানবসঙ্গ করতে আমি আর কাউকে দেখিনি। গৃহাগতদের আপ্যায়নে তিনি ছিলেন সদাপ্রস্তুত। কিছু পানাহার না করে তাঁর ওখান থেকে কারো আসার কোনো উপায় ছিল না।

চট্টগ্রামে সবার জন্যে গৃহের ও হৃদয়ের এমন অবারিত আর কোনো দ্বার কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। অরুণ দাশগুপ্তের মৃত্যুর, কিংবা তারও আগে এ শহর থেকে চিরবিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। বিংশ শতকের শেষ তিন দশক আর একবিংশ শতকের প্রথম দু’দশকএই অর্ধশতাব্দীকাল ধরে চট্টগ্রাম শহরে গড়ে ওঠা অরুণ দাশগুপ্তকেন্দ্রিক এক স্বীকৃতিহীন, পুরস্কারহীন আর সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিক অধ্যায়ে চিরযবনিকা নেমে এসেছে আমাদের অনেকের অজান্তেই, যার বিকল্প গড়ে তোলার কোনো নায়ককে এ শহর হয়তো আর খুঁজে পাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোরা নিভে গেছে
পরবর্তী নিবন্ধডা. সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভাণ্ডারীর ইন্তেকালে শোক প্রকাশ