অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলের কোটি টাকার পুরনো ওয়াগন

প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ রেলওয়ে হারাচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্টেশন ও ডিপোতে বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে অবহেলা আর অযত্নে নষ্ট হচ্ছে রেলের শত কোটি টাকার মালবাহী ওয়াগন, তেলবাহী ট্যাংক, যাত্রীবাহী ক্যারেজ, রেলবিট ও স্লিপার। টাকার হিসেবে কয়েক’শ কোটি টাকা হলেও যেন দেখভালের কেউ নাই জাতীয় এ সম্পদের। এতে যেমন রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে তেমনি পড়ে থাকা এসব ওয়াগন বগির ভেতরে চলছে মাদক সেবনসহ অসামাজিক কার্যক্রম। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ওয়াগনগুলো সংস্কারের সুযোগ নেই বললে চলে। বিক্রয় প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার ফলে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। সরেজমিনে গত কয়েকদিন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হালিশহরের সিজিপিওয়াই, ষোলশহর স্টেশন, মাদারবাড়ি এসআরভি স্টেশনসহ পাহাড়তলীর বিভিন্ন ডিপো ঘুরে দেখা গেছে, বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে শত কোটি টাকার পুরনো যাত্রীবাহী ক্যারেজ, তেলবাহী ট্যাংক, রেলবিট ও স্লিপার, মালবাহী ওয়াগন। নিলামযোগ্য রেলের এসব যন্ত্রাংশ নিয়মমাফিক বিক্রি করা হলে রেলওয়ে পেতো শত কোটি টাকার রাজস্ব। বছরের পর বছর পড়ে থাকা এসব মূল্যবান মালামাল সুরক্ষার কেউ নেই, আর এ সুযোগে চলছে চুরি ও লুটপাট।

হালিশহরে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) এর বিশাল এলাকা জুড়ে খোলা আকাশের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় শত কোটি টাকার মালবাহী ওয়াগন, তেলবাহী ট্যাংক, পুরনো বগি, রেলবিট ও স্লিপার গুলো ঘাসলতাপাতায় ঢেকে আছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ ঝড়বৃষ্টি আর মাটিতে মিশে নষ্ট হচ্ছে। সমানতালে চুরি হচ্ছে। রেল পুলিশের ভাষ্য, এত বিশাল পরিমাণ মালামাল পাহারা দেওয়ার মতো জনবল বা সক্ষমতা তাদের নেই। এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, রেলের অবহেলায় সুযোগ বুঝে চুরি হচ্ছে মালামাল। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রাংশ। আর এই চুরির সাথে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং রেলওয়ের কর্মকর্তাকর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন এবং রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির পাশে সিজিপিওয়াই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ওয়াগন এবং রেলওয়ের যন্ত্রাংশ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম বিভাগ থেকে জানা গেছে, রেলের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্টেশন বা ইয়ার্ডে প্রায় ৩৪ হাজারের মতো ওয়াগান, ক্যারেজ ও তেলের ট্যাংক পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যার ফলে কোটি কোটি লোকসান হচ্ছে রেলওয়ের।

রেলের এসব পুরনো বগিসহ সকল প্রকার যন্ত্রাংশ দেখা শোনা এবং বিক্রি করার দায়িত্বে রয়েছে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক। সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডটি দেখা শুনার দায়িত্ব রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের। এখানে একজন উপসহকারী প্রকৌশলী রয়েছেন। এছাড়াও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীআরএনবি।

একাধিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অবহেলায় চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) ঘিরে রেলের যন্ত্রাংশ চুরির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মূলত এখানকার সংশ্লিষ্ট উপ সহকারী প্রকৌশলী, ম্যানেজার, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সিজিপিওয়াই চৌকির সিআইসহ মিলে রেলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ বিক্রির এই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ের হালিশহর এলাকায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার এরিয়া নিয়ে সিজিপিওয়াই ইয়ার্ডের অবস্থান। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল) রাজস্ব আয়ের প্রধান মাধ্যম। চট্টগ্রাম বন্দরের রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহনকৃত সমস্ত পণ্যকন্টেইনারসিজিপিওয়াই ইয়ার্ড হয়ে সারাদেশে যায়। এই ইয়ার্ডের পুরো এলাকাটিই অরক্ষিত।

এ ব্যাপারে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, সিজিপিওয়াই হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয়ের হৃদপিণ্ড। এই ইয়ার্ড দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দরের সকল কন্টেইনারবাহী পণ্য রেলওয়ের মালবাহী ট্রেন করে ঢাকায় পরিবহন করা হয়। এছাড়াও এই ইয়ার্ডের চার পাশে রেলওয়ের শত শত পুরনো বগিসহ কোটি কোটি টাকার লোহা জাতীয় জিনিস রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই এরিয়ার চারপাশে অনেক আগেই সীমানা প্রাচীর দেয়া উচিত ছিল। এখানে পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বিভাগ বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সীমানা প্রচীর নির্মাণের জন্য চিঠি দিলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা। পুরো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

রেলের যন্ত্রাংশ চুরির পাশাপাশি রেলের এই ইয়ার্ডে তেল চুরির সিন্ডিকেটটি আরো বেপরোয়া বলে জানান স্থানীয়রা। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ আরএনবি এবং ম্যানেজারের যোগসাজসে একদিকে যেমন রেলের যন্ত্রাংশ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ততেমনি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার তেল চুরি করে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে এই ইয়ার্ড থেকে।

চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই)-এর পাশেই একাধিক রেলের তেল চুরির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়তলী রেলওয়ে সেইল ডিপো থেকে নিয়মিতই রেলের দামি দামি যন্ত্রাংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে প্রতিনিয়তই রেলের এসব পুরনো যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত ইঞ্জিন ও রেল ট্যাংক খালি না পাওয়ায় পণ্য পরিবহনে দীর্ঘদিন ধরে ভাটা পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। ২০ বছর আগে যেখানে শতাধিক মালবাহী ওয়াগান এবং অর্ধশতাধিক তেলবাহী গাড়ি চলত, বর্তমানে তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ৭টিতে। মালামাল পরিবহনের এ ঘাটতি হিসাবে ইঞ্জিনের স্বল্পতাকে দায়ি করছেন রেলের কর্মকর্তারা। ফলে আয়ও কমেছে রেলওয়ের। আবার ব্যবহার না হওয়ায় রেলওয়ের প্রায় অধিকাংশ ওয়াগান দেশের বিভিন্ন স্টেশন ও ওয়ার্কশপে নষ্ট হচ্ছে।

সরেজিমনে গিয়ে দেখা যায় ষোলশহর রেল স্টেশনের পেছনে এবং দুইপাশে বছরের পর বছর পরিত্যাক্ত ভাবে পরে আছে রেলের বিপুল পরিমান ওয়াগন, রেলবিটসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। রেল ষ্টেশনের পাশ ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ৫শ’র বেশি অবৈধ বস্তিঘর। দৃষ্টি নন্দন এই ষ্টেশনের পেছনে এবং দুইপাশে ময়লার ভাগাড়। গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। সন্ধ্যার পর পুরো এলাকায় বসে মাদকের হাট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক মাস আগেও ডন আমাকে হুমকি দিয়েছে : নীলা চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধকাভার্ডভ্যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে শিশুর মৃত্যু