অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, যিনি ইবনে সাজ্জাদ নামে খ্যাত। বাংলা রম্যসাহিত্যের প্রকৃতঅর্থে একজন কিংখান। যাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপে স্যাটায়ার সাহিত্য পল্লবিত হয়েছে; পুষ্পফলভারানত হয়েছে। সমকালীন সমাজ–সমস্যা, কাল–জাতির হালচাল তথা সমাজচিন্তার দিক–চতুর্দিক নিয়ে সংবাদপত্রে লেখাজোকায় তাঁর মতো জ্যোতিষ্মান হয়ে বাংলা সাহিত্যে খুব কম জনই এসেছেন। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান যেমনটি বলেন, ‘… তাঁর ভঙ্গিটি ছিলো নিজস্ব এবং অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কলামে এবং প্রকাশিত নির্বাচিত রচনাটিতেও তিনি যে পরিচয়টি রেখে গেছেন সেখানে অন্যদের প্রবেশ দুঃসাধ্য। তার কারণ, তাঁর নিজস্ব ভাষা, ক্লাসিক গল্পকে ভেঙে বিষয়বস্তুর সাথে মিশিয়ে রেফারেন্স তৈরি করার ক্ষমতা এবং সংস্কৃত ও আরবি–ফারসি শব্দের চমৎকার মিশেল দেয়ার কৌশলকে আয়ত্ব করে নেয়ার অধিকার। এসব গুণ তিনি পরিশ্রম করে অর্জন করেছিলেন। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তা শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।’ (সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম, ড. মনিরুজ্জামান, কোহিনূর প্রকাশন, চট্টগ্রাম)
চট্টগ্রামের প্রাচীন দৈনিক ‘আজাদী’ পত্রিকায় ‘ইবনে সাজ্জাদ’– বেনামে একটানা ২২ বছর লিখেছেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান। সেই লেখার অনায়াস গতি আর অনমনীয় শক্তি তাঁর কলাম/ প্রবন্ধকে করেছে খোলাসা, সহজ ও সাবলীল; যেগুলো ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে। একজন শক্তিমান, ধারভার লেখকই কেবল বেনামে লেখার সাহস করতে পারেন। কারণ বেনামে লেখা প্রতিষ্ঠা করা ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং। আমি বলবো, সেই ঝুঁকিতে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের জয় হয়েছে, ইবনে সাজ্জাদের নয়। ইবনে সাজ্জাদের ‘বিরস রচনা’র প্রসঙ্গ উঠতেই অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন। ‘ইবনে সাজ্জাদ’ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানে চাপা পড়ে তখন। সুতরাং চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকি মাড়িয়ে ‘বিরস রচনা’ যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেভাবে ‘ইবনে সাজ্জাদ’ নয়। কারণ তখন বাংলা রম্যগদ্য–সাহিত্যে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের অবস্থান শাশ্বতের পথে। সেখানে বেনাম বা ছদ্মনাম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা নয়।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের অসংখ্য কলামের গভীরে, রসবোধ ও চিন্তার সমন্বয় যেমন ঘটেছে, তেমনি পলে পলে দুঃসাহসও দৃশ্যত হয়। সেই দুঃসাহস কী! সেই দুঃসাহস অবশ্যই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘটনা–দুর্ঘটনা এবং গণতন্ত্রের লেবাসে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে তীর্যক বয়ান। এদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তিনি শ্লেষ করে লেখেন, আমাদের গণতন্ত্রের লিঙ্গবিভ্রাট ঘটেছে! সেই লিঙ্গবিভ্রাট থেকে উত্তরণে গণতন্ত্রকে ‘ঘন’ করবার বয়ান উপস্থাপন করেছেন নিঃশঙ্কে। তিনি তাঁর আরেকটি লেখায় আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের প্রসঙ্গচয়নে বলেছিলেন, ‘আমাদের সমাজজীবনে গণতান্ত্রিক আচরণ রহিয়াছে। আমাদের সমাজে বিবাহে, মেজবানীতে, দাফন–কাফনে লোকজন লোকজনের মতামত গ্রহণ করে, ইহাও এক প্রকার গণতান্ত্রিক আচরণ। কিন্তু রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নাই।’
কেন গণতন্ত্র নাই? তাঁর ধারভার বয়ান– ‘হে সুহৃদ পাঠক, আমাদের গণতন্ত্র এখন খানদানের সমস্যায় পতিত হইয়াছে। বর্তমানে আমাদের রাজনীতিতে কি সাংবিধানিক সংকট হইয়াছে? না সংবিধানে জট পড়িয়াছে? কেহ কেহ কহিতেছে ইহা সাংবিধানিক সংকট। কেহ কহিতেছেন রাজনৈতিক সংকট। কাহারো ধারণা জটের অন্যান্য কিছুর মত ইহাও এক প্রকার জট। রাজনৈতিক/ সাংবিধানিক জট, যানজট, সেশনজট ইত্যাদি নিরসন করা সময়সাপেক্ষ। চুলের জট আঁচড়াইলে সারিয়া যায়। আমাদের প্রথমে জানিতে হইবে ইহা কি রাজনৈতিক সংকট না সাংবিধানিক সংকট, না রাজনৈতিক/ সাংবিধানিক জট? এই সংকট হইতেছে সদিচ্ছার সংকট। …ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া এক কথা নহে। গণতন্ত্রের মমতার সদইচ্ছায় বর্তমান সংকট দূরীভূত করা সম্ভব। গণতন্ত্রের প্রতি যাহাদের সদইচ্ছা দেখিব, জনগণও তাহাদের দেখিবে।’
এই যে, সংকটে গণতন্ত্র! এই সংকট উত্তরণে তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এদেশে ঘটনা–দুর্ঘটনা এবং রক্তপাতের গৌরবদীপ্ত ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ সংকটকাল মোকাবেলায় ছাত্রজনতার ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সংকটকালে ছাত্রগণ আগাইয়া আসিত, ছাত্রগণ রাজনৈতিক কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙ্গাইতেন, কিন্তু এখন?’ খান স্যারের সেই ‘এখন’ প্রশ্নবোধক আজ উত্তর খুঁজে পেয়েছে। তিনি আজ আমাদের মাঝে থাকলে এই বর্ণনা আরো বেশি পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে পারতো। তিনি এ বিষয়ে আরো ভালো বলতে পারতেন এবং লিখতে পারতেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্রের লিঙ্গবিভ্রাট বা সংকটের অন্যতম কারণ দালালি। এদেশের সর্বত্রই দালালির যে প্রতিষ্ঠা, তা প্রত্যক্ষে তিনি তাঁর এক লেখায় দালালি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট খোলার প্রস্তাব করে গেছেন! তিনি দালালিকে দেশ–জাতি–সমাজ ধ্বংসের মহাশক্তি হিসেবে চিহ্নত করেছেন। ফাঁকিবাজি, ধোঁকাবাজি নামের বুদ্ধিজীবীরাও এর সঙ্গে জড়িত বলে মত দেন তিনি। সর্বদালালির মধ্যে রাজনৈতিক দালালিকে তিনি ভয়ঙ্কর বলেছেন। রাজনৈতিক ফড়িয়া বা দালালদের দৌরাত্ম্যে আমাদের মতো ‘গরিবজাদার সাম্রাজ্যে’ দেশপ্রধানের চাকরও কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়; এই সময়ে এসে তাঁর তিন দশক আগে লেখা ‘গরিবজাদার সাম্রাজ্য’ প্রবন্ধ পড়লে সেই হিসাব মিলে যায় অনায়াসে। প্রজাতন্ত্রের চাকর–বাকররা কোটি কোটি টাকা পাচার করে বিদেশে। শত শত বেহেশতি বাড়ি বানায় দূরদেশে। এসব প্রত্যক্ষে বলতে ইচ্ছে করে– কিছু আর মোদের রহিলা না। খান স্যারের ‘গরিবজাদার সাম্রাজ্য’ হয়ে ওঠে লুটপাটের সাম্রাজ্য। তাঁর কলমে পাই, ‘দালাল কথাটি আমাদের দেশে বড়ই নিন্দনীয়। কিন্তু দেখা গিয়াছে যে দালালী এক প্রকারের মহাশক্তি। দালালী করিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বহু লোক বিখ্যাত হইয়া গিয়াছে। আবার দালালী করিতে গিয়া অনেকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হইয়াছে। দালাল কথাটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। দালালী কথাটিকে ব্যাখ্যা করিলে বলিতে হইবে, যিনি রুটি দিবেন তাহার রুচি অনুযায়ী চলিব। কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, গায়িকা, এমন কি অনেক চিত্র–পরিচালকও দালালী করিয়া দেশ–বিদেশের বিখ্যাত ব্যক্তি হইয়াছেন। দালালদের মধ্যে জাত বেজাত রহিয়াছে। গরুর দালাল, আর পাটের দালাল বা বীমার দালাল বা ভোটের দালাল তারা একই কাতারে দাঁড়াইতে পারে না। ভোটের দালাল, গরুর দালাল আর পাটের দালালের জন্য কোনো লাইসেন্স–এর প্রয়োজন নাই। কিন্তু বীমার দালালীর জন্য রীতিমত লাইসেন্স করিতে হয়। দালালের ইংরেজি শব্দ এজেন্ট। দালাল আর এজেন্টের মধ্যে রূপগত, বস্তুগত বা গুণগত কোন তফাৎ নাই। কিন্তু এজেন্ট হইল খান্দানী আর দালাল হইল বদনামী। …দালালী দুই প্রকার– একটি প্রকাশ্যে অপরটি অপ্রকাশ্যে। অপ্রকাশ্য বা গুপ্ত দালালী প্রকাশ হইয়া পড়িলে উহা আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারী নামে অভিহিত হইয়া পড়ে। দালালীর সীমা পরিসীমা নাই। কে দালাল বা কে দালাল নয় বা কোনটি দালালী বা কোনটি দালালী নয় উহার কোন মাপকাঠি আজ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় নাই। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন প্রকার দালাল অবস্থান করিত। বর্তমানে দালাল ও দালালী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহিত সম্পৃক্ত। অর্থনীতিতে যেমন ডিমান্ড সাপ্লাই আছে দালালদেরও তেমনি ডিমান্ড সাপ্লাই আছে। সামন্ত যুগে দালাল অবস্থান বর্তমান যুগের মত এত ব্যাপক ছিল না। মুক্ত বাজারের মত দালালদের বাজারও মুক্ত হইয়াছে। …কেহ কেহ বলিবেন, আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতিই দালাল তৈরীর কারখানা। বৃটিশ–ভারতে মেকলের কারখানায় বৃটিশের দালাল সৃষ্টির জন্য যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হইয়াছিল আমরা উহা খুব বেশী পরিবর্তন করিতে পারি নাই। তবে আমরা যে ধরনের দালাল সৃষ্টি করিতেছি উহা নীচু মানের। এহেন দালাল আজকাল বাজারে চলে না। যে সমস্ত দালাল ইতোপূর্বে খ্যাত হইয়াছে তাহারা অনেকেই বিদেশ হইতে শিক্ষা ও ডিগ্রী লাভ করিয়াছে। স্বদেশে উচ্চমানের দালাল সৃষ্টির জন্য দালালী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট খোলার প্রস্তাব রাখা যাইতে পারে। …দালালি করতে হলে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে করতে হবে। সবাই বাংলাদেশের দালাল হই। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করি। (বিরস রচনা, পৃ. ২৮–৩০)
এভাবে সমকালীন সমাজ–সমস্যা উপস্থাপনে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান তাঁর লেখায় বিশেষ ও ভিন্ন একটি ধারা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর মেধা ও চিন্তার গাম্ভীর্য তথা ব্যাপ্তি অনেক দূর পরিভ্রমণ করেছে। সেই সঙ্গে অধ্যাপনাজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয় তাঁর লেখালেখিকে বৈচিত্র্যে পূর্ণতা আনিয়েছে। এ নিয়ে খানিকটা পুলক, খানিকটা বিনীত আস্ফালন তাঁর ছিলো। এ এক আশ্চর্য বিষয়। তাঁর সেই চিন্তা ও বোধের সঙ্গে বাঙালি সমাজের সাজুয্য ঘটেছে। তাঁর ‘বিরস রচনা’ কিংবা ‘কাঙালের বাসিকথা’ বাংলা সাহিত্যকে সম্মান জানাবার উপচার সাজিয়ে এনেছিলেন যেন। ‘বিরস রচনা’ তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত মূল্যায়ন, সন্দেহ নেই। তাঁর রম্যরচনা বিষয়ের বৈচিত্র্যে বোঝা যায়, লেখকের স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতার তাৎপর্য। তিনি শুধু লেখা দিয়ে নয়, কথা, লেকচার আর বক্তৃতায় তাঁর চিন্তার অন্বিত নন্দন মুগ্ধতা ছড়ায়। তাঁর লেখাজোকা এদেশের ঐতিহ্য, সংকট–সম্ভাবনা, এখানকার আশ্লেষ–সম্ভাষণ, সাহজিকতা, পরস্পরের প্রেম নিবেদনের একাধিক বিন্যাস; বলতে দ্বিধা নেই। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের রম্যসাহিত্য ‘বিরস রচনা’র সঙ্গে মিশে গিয়ে এক পরমাশ্চর্য জাদু সৃষ্টি করেছে। এ যেন তাঁর বাণী বা কলমই হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন। আমরা বলি, তাঁর লেখাজোকার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর অমেয় জীবন। যে জীবন আমাদের সম্বল, আমাদের অহংকার।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের জীবনের জলছবি আরো নানা রঙে রঙিন। তাই তাঁকে নিয়ে কিংবা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে সতত সুখের লাগে। তাঁর কথা পড়লে মনে স্মৃতিরা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। কারণ জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করার সুখ স্বতন্ত্র। তাঁর জীবন নেহাতই সাদামাটা কোনো জীবনস্মৃতি নয়। তিনি প্রস্থিত হয়েছেন এক দশক আগে অথচ তিনি আমাদের মধ্যে আছেন, সেই প্রজ্ঞা আমাদের আকাশকে আনন্দনিষ্যন্দ করে তুলে। আমাদের মুনাজাত, এই দেশে তিনি মানুষের হৃদয়ে ভরপুর হয়ে অমলিন থাকুন আরো, বহুকাল আরো।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রকাশক, গলুই প্রকাশন