অমানবিক ঘটনা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে

শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যা

| শনিবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

শিশুদের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের সহিংসতা লেগেই আছে। নির্যাতনের ধরন আর নৃশংসতা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় মানুষকে পিটিয়ে লাশ করা হয়, তখনও কিছুই হয় না। শিশুদের ওপর চরম অত্যাচার চললেও কিছু হয় না। গবেষকরা বলেন, যে দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর সেরা আইন আছে, যে দেশে স্কুলে-মাদ্রাসায় শিশুর গায়ে হাত তোলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ, সে দেশেই শিশুরা মার খাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বলাৎকারের শিকার হচ্ছে নিজের বিদ্যাপীঠে, কাজের জায়গায়, বাড়িতে, পাড়ায়, চেনাজানা মানুষের হাতে, থানায় ও আদালত চত্বরে। তা নিতান্তই দুঃখজনক।

গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই, চট্টগ্রামে এক বছরে ২৭ শিশুকে হত্যা’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘ধিক্কার, ধিক্কার’ রব ওঠে। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। তবু শিশুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না। উল্টো ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে শিশুকে শারীরিক শাস্তি, সহিংস আক্রমণ, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, হত্যার পর শিশুর লাশ টুকরো করে ফেলে দেওয়া, অপহরণ, ধর্ষণের মতো একের পর এক ঘটনা। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ২৭টি শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে নগরীতে ৯টি শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। জেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে ১৮টি।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে সারা দেশে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫২৬ শিশু। নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ শিশু। ২০১৭ সালে শিশুহত্যা ৩৩৯। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ৯০১ শিশু।

শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের দেখলে এক ধরনের মায়া জন্মে। জগতের অন্য অনেক না পাওয়া, হতাশা ভুলিয়ে দেয় শিশুর নিষ্পাপ মুখ, তার অমলিন হাসি। সেই শিশুরা যখন নির্মম নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়-এরচেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। আর এ ধারণাই অপরাধীদের শিশুদের ওপর পাশবিক আচরণের অভয় দেয়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে।

এ মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনো বিচারাধীন। এছাড়া যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ ধরনের নির্যাতনের মামলাগুলোর মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্নভাবে বেরিয়ে গেছে। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক। শিশুরা নিরীহ ও দুর্বল। এ জন্য সহজেই তারা টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তারা বিচার চাইতে পারে না। শিশু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার এটিও বড় কারণ। যে হারে শিশুহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ চলছে সেটা যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য অশনি সংকেত। একটি সভ্য সমাজ এভাবে চলতে পারে না।

সভ্য সমাজে শিশুর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় হত্যা, খুন অপহরণ, ধর্ষণ তো দূরের কথা। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও শিশুহত্যা নিষেধ। কিন্তু আমাদের সমাজে কেন এসব ঘটছে সেটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিগত দু’দশকে শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে; নেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তের পরও দেখা যাচ্ছে নির্যাতন চলছেই। বিশেষ করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে সহিংসতার ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে শিশুরা অবলীলায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এই নৃশংসতার অবসান হওয়া প্রয়োজন। সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত, সমাজ যদি অপরাধ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তবে যত কঠোর আইনই থাকুক না কেন শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বড় ধরনের সঙ্কট দূর করা অসম্ভব। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা অমানবিক। এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে