অমলিন এক গান রেখে গীতিকবির চিরপ্রস্থান

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ৫ জুলাই, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে। আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই, তাদের স্মৃতির চরণে।’
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতারের যে উজ্জয়িনী গানগুলো মুক্তিকামী বাঙালিকে মরণপণ লড়াইয়ের শক্তি যুগিয়েছিল, যে গানগুলো পাঁচ দশক পর আজও বাংলাদেশের মানুষকে আন্দোলিত করে, এ গান তারই একটি। আবদুল জব্বারের সুরে, তা কণ্ঠে গাওয়া ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসির জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ ২০ বাংলা গানের তালিকায় দ্বাদশ স্থান পায়। বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে অমর এ গানের গীতিকার, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ফজল-এ-খোদা চিরবিদায় নিয়েছেন গতকাল রোববার। খবর বিডিনিউজের।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত কয়েক দিন ধরে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফজল-এ-খোদা। কিন্তু তার আর বাসায় ফেরা হয়নি। গতকাল ভোর ৪টায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তার ছেলে সজীব ওনাসিস।
ফজল-এ-খোদার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতার সঙ্গে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ফজল-এ-খোদা। অবসরে যান বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক হিসেবে।
সজীব ওনাসিস জানান, রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় স্বাস্থবিধি মেনে রায়ের বাজার কবরস্থানে তার বাবাকে সমাহিত করা হয়েছে। তার আগে কবরস্থানের পাশের মসজিদে তার জানাজা হয়। ফজল-এ-খোদার স্ত্রী মাহমুদা সুলতানাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওয়াসিফ-এ-খোদা, ওনাসিস-এ-খোদা (সজীব ওনাসিস) ও ওয়েসিস-এ-খোদা নামে তাদের তিন ছেলে। সজীব জানান, তার বড় ভাই ওয়াসিফ এবং তার স্ত্রী সুমনাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গীতিকবির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা। এছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
জীবদ্দশায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটির পেছনের গল্প বলে গেছেন ফজল-এ-খোদা। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তুলে ধরে ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গানটি লিখেছেন তিনি। গানটি লেখার আগে শিল্পী বশির আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। তখন সুর দেওয়া হলেও রেকর্ডিং আর হয়নি।
দুই বছর পর এল অগ্নিঝরা একাত্তর। শিল্পী আব্দুল জব্বার একদিন ফজল-এ-খোদাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু ভাষা শহীদদের নিয়ে একটি গান করতে বলেছেন। ফজল-এ-খোদা তখন তার লেখা ‘সালাম সালাম’ গানটির কথা বলেন। কিন্তু বেতারে সেই গান প্রচার করতে বাধ সাধেন তখনকার সংগীত বিভাগের প্রধান নাজমুল আলম। তার আপত্তি ছিল গানের ‘বাংলাদেশের লাখো বাঙালি, জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি’ কথাগুলো নিয়ে। পরে ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান খানের পরামর্শে ‘চলে রক্ত ঢালি’ বদলে ‘আনে ফুলের ডালি’ লেখেন গীতিকার ফজল-এ-খোদা।
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ আব্দুল জব্বারের সুরে ও ধীর আলী মিয়ার সংগীতায়োজনে গানটি রেকর্ড করে সেদিন থেকেই প্রচার শুরু হয়। ততদিনে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত সংকেত দিয়ে দিয়েছেন বাংলার মানুষকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সালাম ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি প্রচারের পর কলকাতার হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে ‘সোনার বাংলা’ সিরিজে গানটি আবার রেকর্ড করা হয়। আর স্বাধীনতার পর লন্ডন থেকে বের হয় মিউজিক অব বাংলাদেশ নামে একটি লং প্লে, সেখানে এগারোটি গানের একটি ছিল ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ফজল-এ-খোদার একটি ডায়েরি সংরক্ষিত আছে। তার নিজের হাতে লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান রয়েছে সেখানে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক কবি মিনার মনসুর কয়েক বছর আগে ‘হতভাগ্য এ জনপদের এক উপেক্ষিত প্রদীপ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, এটাকে কবিতা বা গান যাই বলা হোক না কেন, তার উপস্থাপনা সরল কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ নয়। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে তো নয়ই। প্রথম দুটি পংক্তি একেবারেই সাধারণ- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে’, কিন্তু পরবর্তী দুটি পংক্তিতে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়- যখন অবলীলায় কবি বলেন, ‘আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/তাদের স্মৃতির চরণে।’ এ দুটি পংক্তির যে ব্যঞ্জনা, তা কখনো ফুরাবে বলে মনে হয় না।”
১৯৪১ সালের ৯ মার্চ পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে ফজল-এ-খোদার জন্ম। তার বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স, আর মা মোসাম্মাৎ জয়নবুন্নেছা। এক সাক্ষাৎকারে ফজল-এ-খোদা বলেছিলেন, যখন প্রথম গান লিখেছিলেন তখন ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ক্যাডেট। সেখানকার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ‘আমাদের দেশটা সুজলা সুফলা/ কী সুন্দর কী চমৎকার মুখে যায় না বলা’ শিরোনামে একটি বাংলা গান লেখার দায়ে তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল। পরে চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসেন।
১৯৬৩ সালে বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসাবে যাত্রা শুরুর পর ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনেও গীতিকার হিসেবে তিনি তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক হিসেবে অবসরে যান তিনি। গীতিকার হিসেবে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ী পরে কোন রমণী চলে যায়’, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘প্রেমের এক নাম জীবন’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো, পথের ধুলোয় লুটোবে’র মতো গান লিখেছেন তিনি। তার লেখা গানে সুরারোপ করেছেন আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশগুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য, সত্য সাহার মতো সংগীতজ্ঞরা। তার গান কণ্ঠে তুলে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন বশীর আহমেদ, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো শিল্পীরা।
মূলত গীতিকার হিসেবে পরিচিত পেলেও কৈশোর থেকে ছড়া-কবিতা লেখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফজল-এ-খোদা। ১০টি ছড়াগ্রন্থ ছাড়াও ৫টির কবিতাগ্রন্থসহ মোট ৩৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ থেকে ভারতে উপহার ট্রাকভর্তি হাড়িভাঙ্গা আম
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে দুই পক্ষে মারামারি, আহত ১০