অমর একুশের এক নির্ভীক কলমযোদ্ধা

নুজহাত নূর সাদিয়া | মঙ্গলবার , ৭ জুন, ২০২২ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ


এই যে ধুমকেতু কী খবর, নতুন কী লিখেছ? আমার কৌতুহল ভরা দৃষ্টির সামনে তাঁর সে চিরসবুজ বুদ্ধিদ্বীপ্ত চোখ দু’টি হেসে উঠত সবসময়। নুজহাত, কবি নজরুলের সে বিখ্যাত ধুমকেতুর কথা কি আর সাধে বলি! আচমকা উদয় হও, সাংবাদিকতা এত সোজা নয়, প্রচুর পড়তে হবে, না পড়লে লিখবে কী করে? আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবন -সংসারি মেয়ে নিয়মিত না হলে টিকে থাকবে কী করে।

আহা, কত অসংখ্য স্মৃতি, কত চমৎকার রসবোধে ভরা উপভোগ্য ইতিহাসনামা আর এমনি সব টুকরো উপদেশ সময়ে সময়ে পেশাগত কাজের ফাঁকে, আলাপচারিতায় অথবা নিতান্ত কথার ছলে আমার কর্ণকুহরে কোকিল ডেকেছে। মন ও মনন সময়ে সময়ে তাতে সায় দিয়েছে আবার ক্ষেত্র বিশেষে নিতান্ত অলসতার অজুহাত তুলে সে মূল্যবান তথ্যবহুল দিনপঞ্জিকাটিকে মস্তিষ্কের সূক্ষ্ণ নিউরনে সিন্দুকবন্দি করে রেখেছি। সে সিন্দুকের চাবির মূল কারিগরটি আজ আর কর্ণকুহরে মধু ঢালতে অপেক্ষমাণ নন, চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন অমর একুশে গানের অমর স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরি। লন্ডনের বারনেট হাসপাতালের হিমঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত মানুষটিকে সাদর সম্ভাষণে বরণ করে নিয়েছে বাঙালি জাতি, তাঁর অতি প্রিয় সবুজ বদ্বীপটি, তাঁর ভাষায় সোনার বাংলা।

হাজার হাজার পাঠকের অন্যতম পছন্দের খ্যাতনামা সাংবাদিকটির গণমাধ্যমের সে বহুল উচ্চারিত নাম ‘গাফফার ভাই’ সম্ভাষণটি বয়সের বিবেচনাধীন তারতম্যের কারণেই অনুচ্চারিত ছিল আমার কণ্ঠে। তাঁরই দেওয়া সম্ভাষণ ‘চাচা’ ডাকটি হয়তো বা বেশ খানিকটা ঘরোয়া পরিবেশ পাওয়ার আশায় লুফে নিয়েছিলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নিরাশ হইনি।

একটু পেছন ফিরি, ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের সে ঐতিহাসিক পত্রিকা ‘জনমতের’ প্রাঙ্গণে এই কীর্তিমানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। জনমত পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি, কমিউনিটি সংবাদ বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন আর সাক্ষাৎকার তৈরির কাজ শিখছি বিলেতের দু‘প্রথিতযশা সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশা আর নবাব উদ্দিনের ছাঁয়ায় আর একটু একটু করে সে কিংবদন্তির বিপুল জ্ঞান আর বর্ণাঢ্য কর্ম অভিজ্ঞতার পরশ পাওয়া শুরু করেছি।

পরশ পাথর মহৌষধির কাজ করল, শখের লেখিকা পুরোদস্তুর সাংবাদিক বনে গেল। নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম বিলেতসহ বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। সময় গড়িয়ে চলল, অভিজ্ঞতার ঝুলিটি ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে লাগল আর বুকের ভেতর লুকোনো আকাঙ্ক্ষার পারদটি ক্রমশ মাথাচাড়া দিতে লাগল।

সময়কাল ২০১৭ সাল, আমার সে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার পারদটির সলতে টুকুতে আগুন ধরিয়ে দিল সবসময়ের উৎসাহদাতা জনাব ও পরিবার। বিশেষ করে জীবনসঙ্গীর যে বিশেষ বার্তাটি সাহস করে আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে-দেখো কালজয়ী অমর একুশে গানের স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরি থেকে যাবেন তাঁর কলামে, সাহিত্যে আর সাংবাদিকতায়। তবে, নিত্য বাড়ন্ত এই নব্য ইংরেজি বুলির যুগে নব প্রজন্মকে তাদের প্রকৃত ভিত্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই প্রয়োজন অমর একুশে গানের রচয়িতার পূর্ণাঙ্গ জীবনীর উপর আলো ফেলা!

কাজে নেমে পড়লাম, ফোনের উপর ফোন দূরালাপনীর খরচের খাতায় কত অংক জমা পড়ল তার হিসেব রাখিনি। কে পড়বে আমার এ আত্মজীবনী? বাজারে অনেক কথা প্রচলিত। নাছোড়বান্দা এ আমি অনুগত নবীন কর্মীর মত প্রাজ্ঞ প্রবীণটিকে বোঝানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত। মাথায় রীতিমত ভূত চেপে বসল, এর শেষ না দেখে ছাঁড়ছি না। প্রায় সাড়ে তিনমাস পর স্রষ্টা সদয় হলেন, কিংবদন্তীর মনের জমাটবাধা দ্বিধা আর কিছুটা সংশয়ের মিশেলের শক্ত বরফটি একটু একটু করে খরস্রোতা নদীতে পরিণত হতে শুরু করল। আজ মনে হয়, অপত্য স্নেহ আর এক উদীয়মানের কর্ম উৎসাহের পালে হাওয়া লাগানো এ দু‘য়ের অকৃত্রিম গেঁরোকে বাস্তবতার পাথুরে মাটিতে স্বীকৃতি দিতেই অভিজ্ঞ লেখকটির অনুরোধের ঢেঁকি গেলা। যদিও পরবর্তীতে কাজের ফাঁকে আপাত পেশাদার মানুষটির সরল স্বীকারোক্তি- বুঝেছ, আমার এই এক সমস্যা সহজে কাউকে না বলতে পারি না।

অমর একুশের এক নির্ভীক কলমযোদ্ধা; তাঁর আত্নজীবনীর জন্য আমার প্রস্তাবিত নামটি তিনি বিনা দ্বিধায় পছন্দ করলেন। অবাক হয়েছিলাম এত বড় মাপের সাহিত্যিকের এমন বিনম্র আচরণে! আশ্বস্ত করলেন এই বলে, তোমার কাজ তোমার দেওয়া নামই তো থাকা উচিত তাই না।

এক ঘোর বর্ষার দিন, ২০১৭ সালের ৯ জুলাই বহুল প্রতীক্ষিত সে দিনটিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রয়াত কলামিস্টের আত্মজীবনীটি লেখা শুরু করলাম। পাক্কা দু‘বছর তাঁর শারীরিক অবস্থার টানাপোড়েন আর পারিপার্শ্বিকতার জের এই মিলিয়ে অবশেষে ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই তাঁর ধারাবিবরণীতে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের লেখনীতে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানলাম। স্মিত হেসে বলেছিলেন- এখন বুঝতে পারছি ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিঞা কেন ধারাবিবরণী দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন! কী কষ্টরে বাবা, এখন তো ডায়রিও লিখি না কতকিছু স্মৃতি খুঁড়ে বলতে হয়। অথচ, এ আমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হতাম প্রবীণ মানুষটির আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, প্রতিদিন ভোর ৬টার মধ্যে লেখার টেবিলে বসে পড়ার অদম্য স্পৃহা দেখে, অসংখ্য মানুষের নানা অসময়োচিত আবদার রক্ষার একনিষ্ঠতা আর জ্ঞানের এক অতল ভাণ্ডারের ছোঁয়া পেয়ে।

স্মৃতিময় এই পেশাদারিত্বের ফাঁকে ফাঁকে কখনো তাঁকে দেখেছি-বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনের দায়িত্বশীল জবাব দিতে, কখনোবা লেখক মুনতাসীর মামুন, ব্যারিস্টার সুলতান শরীফ সহ লন্ডস্থ বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ নিয়াজ আহমেদের সাথে রাজনৈতিক যুক্তি-তর্কের প্রাণবন্ত আলোচনায় সরব হতে কখনোবা তাঁর শেষ বয়সের অকৃত্রিম সুহৃদ তাঁর সন্তান-সন্ততির সাথে একান্ত সময় কাটাতে।

ভোজনরসিক এ মানুষটির প্রিয় পটল ভাজাসহ নানা উপাদেয় খাবার তাঁর সাথে এক টেবিলে বসে উদরপূর্তি করতে করতেই মনতুষ্টি হতো তাঁর অমূল্য বাণী চিরন্তনীতে; এই যে চেয়ারটিতে তুমি বসলে, সেখানটিতে প্রয়াত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক বসে ছিলেন। হুমায়ূনের কিছু লেখা ভাল, তবে কিছু লেখা পড়ার পর আর মনে থাকে না। সাংবাদিক বন্ধু মুসা ভাল মানুষ ছিলেন, প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, তুমি চাইলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত লেবার নেতা ‘মাইকেল বার্নস’ আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট নির্মাতা ‘বিমান মল্লিকের’ উপর কাজ করতে পার। যোগ্য মেয়েদের মিডিয়ায় আসা আরও বেশি প্রয়োজন, যাতে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।

বিপরীত রাজনৈতিক মতের অনুসারী অথচ প্রাণের বন্ধু আরেক বিখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমানের সাথে তাঁর একটি যুগল সাক্ষাৎকারের ইচ্ছে নানা কারণেই আলোর মুখ দেখেনি। বিশ্বস্ত শিষ্যের সর্বশেষ আক্ষেপ ছিল, বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবনীর উপর ডকুমেন্টারি তৈরীর কাজটি পরিপূর্ণতা না পাওয়া।

কাকতালীয়ভাবে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস হতে জনমতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আত্মজীবনীটির প্রকৃত মূল্যায়ন-অনেক কষ্ট করেছ। মজার ব্যাপার বঙ্গবন্ধুর আজীবন অনুসারী কিংবদন্তী সাংবাদিকটির লন্ডনের এজোয়ার রোডের বাড়িটির যাবার রাস্তা ক্রিসেন্ট লেইন তাঁর পারিবারিক ডাক নাম চান্দু (চাঁদ)‘র সাথে মিলে যায়। অন্তিম ইচ্ছে অনুসারে জন্মভূমি বাংলাদেশই এই কিংবদন্তীর শেষ ঠিকানা। তবে প্রিয়তমা পত্নীর স্মৃতি বিজড়িত ৫৬, ম্যাথিউন রোডের এ ঐতিহাসিক আবাসটি কি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্মারক হয়ে থাকতে পারে না! বিদায় কিংবদন্তি, বিদায় ত্রিকালদর্শী সাংবাদিক।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনের রসনাবিলাস
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর