যুদ্ধের এক চিরন্তন আবছায়া অধ্যায় হল নারী। যুগে যুগে বিশ্বজুড়ে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার যন্ত্রণাময় অধ্যায় রচিত হয়েছে নারীর জীবনে এবং এই অংশটুকু সবসময় রয়ে যায় চোখের আড়ালে। বৈষম্যমূলক অবস্থানের কারণে যুদ্ধ একটা চিরস্থায়ী ছায়া ফেলে যায় নারীর জীবনে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এমন এক অধ্যায় নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘তালাশ’ এর জন্য কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার এবার এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত হয়েছেন। এটা ছিল এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ডের তৃতীয় আসর। এ-মাসের ১ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে এ-ঘোষণা দেওয়া হয়। এশীয় সাহিত্যকে আলাদা মানদণ্ডে বিচার করার তাগিদ থেকে ২০১৭ থেকে ‘এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড’ চালু করা হয়। এর আর্থিক মূল্যমান বাংলাদেশী মুদ্রায় পনের লাখ টাকা।
কথা সাহিত্যিক শাহীন আখতার ‘তালাশ’-এ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের যৌন নিপীড়ন এবং পরবর্তীতে সমাজে তাঁদের যে বঞ্চনা তা তুলে ধরেছেন। শাহীন আখতার তাঁর উপন্যাসে যুদ্ধ এবং নারীবাদকে মূল উপজীব্য করেছেন। তাই সব ছাড়িয়ে উপন্যাসটি বিশ্বজনীন এক রূপ পেয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা লাঞ্ছিত হয়েছিল পাকিস্তানের সৈন্যদের দ্বারা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এদেশের রাজাকার, আলবদর নরপশুদের দ্বারা। কিন্তু যুদ্ধে নির্যাতিত এই নারীদের প্রতি যুদ্ধ পরবর্তী আমাদের সমাজ কোনভাবেই মানবিক আচরণ করেনি। সেখানেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীদের প্রতি সমাজের বৈষম্যের তীব্র প্রকাশ। যুদ্ধের মহিমাকে ছাপিয়ে অমানবিক এই দিকটাই প্রকট হয়েছে, সমালোচিত হয়েছে উপন্যাসে।
শাহীন আখতার যখন সমাজের এই বৈষম্যমূলক এবং অমানবিক দিকটা নিয়ে কাজ করতে যান তখনই তিনি এই অন্ধকার দিকটা নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নেন। মূল চরিত্র মরিয়মকে ঘিরে তিন দশক ধরে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। মরিয়ম, টুকি বেগম, অনুরাধা, মুক্তি চরিত্রগুলো লড়াই করে চলেছে সমাজের অন্ধকার, অদৃশ্য বৈষম্যের সাথে।
লেখক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের উন্মাদনা আর পুরুষের ভ্রান্ত চেতনাকে উপহাস করেছেন, সমালোচনা করেছেন ব্যাঙ্গাত্নক উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি বিস্তৃত এক সময় কাঠামোতে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক বৈষম্য, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার, যুদ্ধে নিগৃহীত নারীদের আরেক জীবন যুদ্ধ, ধর্ষণ সবই তুলে এনেছেন।
উপন্যাসে লেখক একাধারে যুদ্ধ এবং সমাজকে নারী নিপীড়নের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যা শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা হয়ে আবদ্ধ থাকেনি, প্রকাশিত হয়েছে সকল যুদ্ধ এবং সকল সমাজে নারী নিপীড়নের চিহ্ন হিসেবে। বিচারকেরা তাই ‘তালাশ’ কে অন্যতম নারীবাদী এবং যুদ্ধ বিরোধী ডকু-উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
২০১১ সালে ‘দ্য সার্চ’ নামে তালাশ-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করা হয় দিল্লিস্থ প্রকাশনা হাউজ জুবান থেকে। ‘তালাশ’ কোরিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন প্রফেসর সিং হি জন ও ফারহানা শশী। এশিয়া থেকে ২৯ জন লেখকের লেখা ‘এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ডে’ অংশগ্রহণ করে। তাঁর মধ্য থেকে শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ কে নির্বাচিত করা হয় বিজয়ী হিসেবে। চীন এবং তাইওয়ানের দুইজন নারী লেখকের বইও সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। নারীবাদী লেখাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবারে এশিয়ান লিটারেচার অ্যাওয়ার্ডের মূল থিম ঠিক করা হয়।
শাহীন আখতার ২০১৫ তে বাংলা একাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি আখতারুজ্জান সাহিত্য পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারও অর্জন করেন। ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘অসুখী দিন’, ‘সখি রঙ্গমালা’, ‘শ্রীমতির জীবন দর্শন’ ইত্যাদি লেখকের উল্লেখযোগ্য বই। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘গল্প সংগ্রহ-১’, ‘গদ্য সংগ্রহ-১’। তিনি ১৯৬২ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন।