সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন যে, নগরীর সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে, সৌন্দর্য বন্ধনে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন নয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বর্তমান পর্ষদের দ্বিতীয় সাধারণ সভায় এসব কথা বলেন তিনি। গত সোমবার আন্দরকিল্লাস্থ নগর ভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন মেয়র। তিনি বলেন, খাল, নালা-নর্দমা এবং সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করা হবে। নগরীর সৌন্দর্য বন্ধনের চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা চলবে না এবং সৌন্দর্য বর্ধনের নামে নিন্দিত কিছু সহ্য করা হবে না।
উচ্ছেদ নিয়ে চলে ইঁদুর বিড়াল খেলা। আজ উচ্ছেদ তো কাল সেই জায়গায়ই নতুন করে স্থাপনা তৈরি হয়। দেশের অর্থনীতির প্রাণখ্যাত কর্ণফুলী নদীর তীর নিয়ে বছরের পর বছর এভাবেই চলছে কানামাছি খেলা। তীর দখল করে কেউ গড়েছে বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড। আবার কেউ বসিয়েছে নৌ-পারাপারের ঘাট। গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের দোকানপাট। কর্ণফুলী নদীর উত্তর তীরে জেগে ওঠা চর দখল করে গড়ে তোলা বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উদ্ধার করা হয় কয়েক একর জমি। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় ফের ওই জমি বেদখল হয়ে যায়। এর পর ফের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ওই জায়গা পুনরুদ্ধার করা হয়। কিন্তু পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, নতুন করে স্থাপনা গড়তে সক্রিয় হয়ে উঠেছে দখলদাররা। প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কারণেই উদ্ধার হওয়া জায়গায় পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনেও ঠেকানো যাচ্ছে না কর্ণফুলীর দখল-দূষণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে অবৈধ দখলদাররা প্রভাবশালী এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা সীমিত। দূষণ এবং অবৈধ দখলের হাত থেকে নদ-নদী, খাল-বিল বা জলাশয় রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানান পদক্ষেপের কথা এসেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। যদিও আদালত সারাদেশে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তা জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে। দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল এবং জলাশয়ের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির নির্দেশও এসেছে।
এ কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশে অন্যের জায়গায় অন্যায়ভাবে স্থাপনা গড়ে তোলার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ‘অন্য’ যদি হয় রাষ্ট্র বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা বিভাগ, যারা নিজেদের ফাঁকা, অব্যবহৃত জায়গাজমির নিয়মিত তদারকি করে না, তাহলে তাদের সেসব জায়গায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষত, সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় অবৈধভাবে দোকানপাট, ছোটখাটো কারখানা, এমনকি বিপণিবিতানও গড়ে তোলা হয়। শহর-উপশহরের ফুটপাত তো বটেই, বাজার এলাকায়ও খাসজমিতে অবৈধভাবে দোকানপাট, এমনকি পাকা মার্কেটও গড়ে তোলা হয়। রাতারাতি কোথাও কিছু গড়ে ওঠে না; এসব অবৈধ নির্মাণকাজ চলে দিনের পর দিন, বহু বছর ধরে। তারপর হয়তো হঠাৎ একটি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, তখন অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করার অভিযান শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা প্রচুরসংখ্যক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার অভিযান শুরু হলে স্থাপনার মালিকেরা প্রতিবাদ করেন, কেউ কেউ আদালতে মামলাও করেন এই দাবি করে যে তাঁর স্থাপনা অবৈধ নয়, তিনি জায়গাটি কিনেছেন অমুক বা তমুক ব্যক্তির কাছ থেকে। এই নিয়ে আদালতে মামলা চলে, আদালত হয়তো স্থগিতাদেশ দেন, কিংবা হয়তো উচ্ছেদ অভিযানের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু তারপরও সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না ‘প্রভাবশালী’ গোষ্ঠী বা মহলের চাপে। মাঝপথে উচ্ছেদ অভিযান থেমে যায়।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে হতে হবে নির্মোহ ও কঠোর। যত বড় প্রভাবশালীই হোন না কেন, ন্যায় আর সত্যের জন্য তাঁকে দৃঢ় থাকতে হবে।