প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সাথে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র।এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বহারা হচ্ছে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ। আইন বহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের এহেন কার্যক্রমে চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। গত ১ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে এ বিষয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের টার্গেট দরিদ্র মানুষ, মোটা অংকের টাকার চুক্তি হলেও ঠকানো হয় দাতাকে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিনই বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। এ রোগীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দেশব্যাপী সক্রিয় ভয়ঙ্কর কিডনি ও লিভার পাচার চক্র। এই চক্র আর্থিক সঙ্কটে পড়া লোকদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি ও লিভার সংগ্রহ করে। রোগীর আত্মীয়ের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের দেখানো হতো দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কের জাল কাগজপত্র। অর্থের বিনিময়ে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনা অবৈধ হওয়ায় চক্রটি আগ্রহী দাতাদের সঙ্গে গ্রহীতাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এমন ভুয়া প্রমাণপত্রের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করে। মাঝে মধ্যে র্যাবের অভিযানে কখনো চট্টগ্রাম আবার কখনো ঢাকায় চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও থেমে নেই তাদের অপতৎপরতা। অভিযোগ রয়েছে, কিডনি ডোনার হিসেবে তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে। তাদের সাথে মোটা অংকের অর্থের চুক্তি হয়। কিন্তু কিডনি দানের পর ঠকানো হয় দাতাকে। দেওয়া হয় প্রতিশ্রুত অর্থের চেয়ে অনেক কম। এই ক্ষোভ থেকে অনেকে পৃথক গ্রুপ তৈরি করে এধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বেই উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে কিডনিজনিত সমস্যা। আর বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকলের শিকার হন। চিকিৎসকরা জানান, চাহিদার তুলনায় দাতা কম বলে কিডনির বাজারমূল্যও উচ্চ। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকতে হয় ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল।
র্যাব–১ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোস্তাক জানান, কিডনি গ্রহীতা বিত্তশালী হলে কিডনি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকাও নেওয়া হত। কিন্তু কিডনিদাতাকে দেওয়া হত ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। ভারতের চক্রটি বাকি টাকার প্রায় অর্ধেক নিয়ে যেত। আর বাকি টাকার বেশিরভাগ রাখতেন সিন্ডিকেটের প্রধান আনিছুর। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষকে টার্গেট করে টাকার লোভ দেখাত এরা। অসুস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলেও ফাঁদ ফেলতো। একই ভাবে গত বছর র্যাব–৭ এর হাতে ধরা পড়ে চট্টগ্রামে ডোনেশনের নামে ভারতে কিডনি ও লিভার পাচার করে আসা সংঘবদ্ধ আরেকটি চক্র। এ চক্রের দলনেতা ডালিম। জিজ্ঞাসাবাদে মানবদেহের কিডনি ও লিভার পাচারকারী সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রের বিভিন্ন তথ্য দেয় তারা। এর আগে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে কিডনি কেনাবেচায় জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব–২।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিডনি কেনাবেচা বন্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কিডনির ব্যবসা বড় পরিসরে চলছে। তাঁরা বলেন, দেশের নিম্নআয়ের মানুষ অনেকে টাকার অভাবে কিডনি বিক্রি করছে। প্রতারকরা এদের কিডনি নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারণা করছে। এসব প্রতারক ভারতের যেকোনো হাসপাতালের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে দীর্ঘদিন ধরে এরকম অপরাধ করে আসছে। এ চক্রটি একটি কিডনির জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ২০–২৫ লাখ টাকা নিয়ে থাকে, যা খুবই দুঃখজনক। বলা আবশ্যক যে, এবং একই সঙ্গে আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, আমাদের দেশে এখনো মানুষ মানুষের বিপদে আপদে ছুটে যান, এখনো মানবিক আহ্বানে সাড়া দেন। তাই মানবিক কারণে কেউ যদি কাউকে অঙ্গ দান করেন, তাহলে তা দোষের হতে পারে না। কিন্তু যারা অবৈধ প্রক্রিয়ায় কিডনি ও লিভার বেচাকেনা করে এবং ফাঁদ পাতে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তাদের আইনের আওতায় এনে অবশ্যই শাস্তি প্রদান করা দরকার।