সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কিছু মানুষ এ জগতে মহৎ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানব কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করে অমর হয়ে থাকেন। মরহুম নূর আহমদ তেমনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যার তুলনা বিরল।
চট্টগ্রাম শহরের আলকরনের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে নূর আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর। লেখাপড়ার প্রতি তার ছিল এক অদম্য স্পৃহা। এনায়েতবাজার প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি লাভের মধ্য দিয়ে তিনি এ অধ্যায়ের সুচনা করেন। নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও তিনি বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১০ সালে কৃতিত্বের সাথে জেলা বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা (এনট্রান্স) পাস করেন। মেধার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯১২ সালে বিভাগীয় বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিভাগে আই.এ. পরীক্ষা এবং একই কলেজ থেকে ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করে মেধা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তিতে তিনি চ্যান্সেলর্স্ স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন।
দেশ ও জাতির সেবাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তাই তিনি ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কমিশনার পদে নির্বাচিত হন। জীবনের প্রথম এ নির্বাচনে জয়লাভ তার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এবং শ্রদ্ধারই বহি:প্রকাশ। কমিশনার হিসাবে তিন বৎসর দায়িত্ব পালন করে মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন আর নিজের দক্ষতার এমন স্বাক্ষর রাখলেন যে কামেয়ী স্বার্থবাদীদের বিরোধিতার মুখেও তিনি ১৯২১ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন যে পদে দীর্ঘ ৩৩ বছর আসীন থেকে ১৯৫৪ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি পৌরসভা থেকে কোনো ভাতা গ্রহণ করতেন না। দীর্ঘ ৩৩ বছর চেয়াম্যান থাকাটা একথাই প্রমাণ করে যে তাঁর সততা, দক্ষতা, কর্তব্যবোধ প্রশ্নাতীত ছিল এবং পৌরজনের হৃদয়ে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন।
চেয়ারম্যান হিসাবে যখন নূর আহমদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে সময়ের চট্টগ্রাম শহর ছিল অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত—শহরের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহই ছিল না। তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের জনগণের শিক্ষার এ করুন অবস্থা তাকে দারুনভাবে পীড়িত করেছিল। তিনি সর্বাগ্রে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের উপর। কারণ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সমাজের যে কোনো ক্ষেত্রের উন্নয়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে শিক্ষা। তাই দায়িত্ব নেয়ার পরই জনাব নূর আহমদ তার প্রথম জীবনের লালিত আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার আলোয় আপামর জনগণকে আলোকিত করার মহান লক্ষ্যকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু করে দেন। এ ক্ষেত্রে তাকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। একেত পৌরসভার সীমিত সম্পদ তার উপর কোনো পৌর কর্তৃপক্ষের শিক্ষা বিভাগ পরিচালনার কোনো নজীর নেই। পৌরসভার অধীনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা তার জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র নন। দৃঢ় প্রত্যয় তাকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহস যুগিয়েছে।
তিনি ১৯২৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম পৌর এলাকায় বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে বহু কাঙ্ক্ষিত সে দু:সাহসী ও যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৯২৮ সালে তা মেয়েদের জন্যও বাধ্যতামূলক করে তিনি প্রতিটি এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে দুর্গম পথযাত্রা শুরু করেন। শহরের ধনাঢ্য ও বিত্তবানদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে থাকেন সহযোগিতা আর বিদ্যালয়ের জন্য জায়গা সংগ্রহের লক্ষ্যে। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাকে কিছু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– (১) চট্টগ্রাম পৌর এলাকার ৬ বছর বয়সের প্রত্যেক বালক বালিকাকে বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে পাঠানো (২) ছেলে–মেয়েরা বিনা কারণে একাক্রমে ১৫ দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে অভিভাবকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ (৩) মেয়েদের স্কুলগুলোতে ঝি নিয়োগ করে মেয়েদের বাসা থেকে আনা–নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ (৪) শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন ও পাঠদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পৌরসভায় স্কুল পরিদর্শক পদে কর্মকর্তা নিয়োগ ইত্যাদি। শিক্ষার উন্নতিতে তার এই ব্যবস্থা সমগ্র দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া জুড়ে সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা স্মরণ করতে গিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক ১৯৪২ সালে তৎকালীন বঙ্গীয় আইন পরিষদে বলেছিলেন– ‘শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার মানুষ আজ আর পিছিয়ে নেই। আমি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হতে এ পর্যন্ত শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালকের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে শিক্ষার হার ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হারের দিক দিয়ে সমগ্র বাংলার (অবিভক্ত বাংলা) পৌর এলাকায় চট্টগ্রাম পৌর এলাকা সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। আর চট্টগ্রাম পৌর এলাকার এই সম্মানজনক অবস্থানের জন্য কৃতিত্বের দাবীদার হলেন এই পরিষদের সম্মানিত সদস্য জনাব নূর আহমদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি’ (বঙ্গীয় আইন পরিষদ কার্যবিবরণী,১৯৪২/পৃষ্ঠা২১৭–২১৯/তাং–১৭–৭–৪২ ইংরেজী/ভলিয়্যুম–৭)।
একইভাবে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আমলেও চট্টগ্রাম পৌর এলাকাকে শিক্ষার হারের দিক দিয়ে সমগ্র পাকিস্তানে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুর রহমান ১৯৫২ সালে এক প্রশ্নোত্তরে বলেছিলেন– ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সম্মানজনকভাবে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমগ্র দেশে (পাকিস্তানে) এলাকাভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম পৌর এলাকা এখনও সর্বোচ্চ হারের আসনে অধিষ্ঠিত। বৃটিশ শাসনামলেও একই অবস্থানে ছিল। এটার সফল কৃতিত্বের দাবীদার হলেন এই পরিষদের সম্মানিত সদস্য জনাব নূর আহমদ। সমগ্র পরিষদের সাথে সরকার ও আমি এজন্য গর্ববোধ করছি এবং তাঁর এই অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য মোবারকবাদ জানাচ্ছি’ (পাকিস্তান গণপরিষদের কার্যবিবরণী/ভলিয়্যুম–২৭/তাং–২–৩–৫২/পৃষ্ঠা ১০৭–১১২)
তার মেয়াদকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার পরিচালনায় মোট প্রায় ৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পৌর প্রশাসক লে.ক. জহুরুল হাসান আলকরনস্থ পৌর প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়কে নিম্ন মাধ্যমিক (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত )বিদ্যালয়ে উন্নীত করে আর এক অধ্যায়ের সূচনা করেন এবং এ বিদ্যালয়ের নাম নূর আহমদ–এর নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
তিনি পৌরবাসীর জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে দামপাড়ায় স্থাপন করেন ওয়াটার ওয়ার্কস আর রাস্তায় বসান পানির কল। রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থাও তার সময়ে সম্পাদিত হয়েছিল। লালদিঘি পাড়ের মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি শহরের গরীব জনগণের পৌর ট্যাক্স মাফ করার ব্যাপারে ছিলেন উদারহস্ত।
জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর বিশ্বাসের উপর ভর করে তিনি ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আর এ সাথে সংযোজন হয় তার জীবনের আর এক স্বর্ণালী অধ্যায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন প্রথিতযশা পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে স্থান করে নেন। জনকল্যাণমূলক আইন প্রণয়নে তিনি বলিষ্ঠ ভুমিকা অব্যাহত রাখেন। প্রজাস্বত্ব আইন, সূর্যাস্ত আইন বিলোপ সাধন, যৌতুক প্রথা বিলোপ প্রস্তাব, ওয়াকফ্ ও দেবোত্তর আইন পাশ তার অনন্য ভুমিকার নিদর্শন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রসঙ্গ এলেই জনাব নূর আহমদ চেয়ারম্যানের নাম প্রথমেই চলে আসে। অবিভক্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসাবে জনাব নূর আহমদ বৃটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করে চট্টগ্রাম পৌরসভার পক্ষ থেকে তৎসময়ে পাঁচশ’ টাকার একখানি চেক প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হকের নিকট হস্তান্তর করেছিলেন (দৈনিক আজাদ ও স্টেটসম্যান/পৃষ্ঠা–৩ তাং–২৮–৭–৪২)। প্রবহমানকাল ধরে চট্টগ্রামবাসীর কাছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবক হিসাবে জনাব নূর আহমদ চেয়ারম্যান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তিনিই প্রথম তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদে হোমিওপ্যাথিক বিল উত্থাপন করেন যার ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথিক বোর্ড গঠিত হয়। চট্টগ্রামে মেরিন স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে পাশ করান যার ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যেমন ছিলেন জ্ঞানের প্রচারক তেমনি ছিলেন জ্ঞানের সাধক। পৌরসভা এবং রাজনৈতিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি ইংরেজী ভায়ায় ১৪টি বই লিখেন।
জনাব নূর আহমদ চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রতিনিধি হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট কমিশনার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বন্দরের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উপর শুধু বক্তব্য রাখেননি বরং চট্টগ্রাম বন্দরকে শ্রেষ্ঠ বন্দরে উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবাদি ও আইন সংশোধনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। আমাদের দেশে অনেক শক্তিধর নেতা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভের উর্ধ্বে উঠতে পারেননি বলে শেষ পর্যন্ত জনতা কর্তৃক ধিকৃত হয়েছেন, বাইরে লাল টুকটুক ভেতরে পোকায় ভর্তি সিঁদুরে আম হয়েছেন এবং ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। জনগণের দুঃখ–কষ্ট লাঘব ও সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য বিধান ছিল নুর আহমদের জীবন সাধনা। ১৯৬৪ সালের ২২ শে অক্টোবর তিনি আলকরণস্থ নিজ বাড়িতেই ইন্তেকাল করেন।