গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসে চার শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হিসেবে ৭ জনের নাম উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। অভিযুক্ত ৭ জনের মধ্যে অভিজিৎ দাশ ও মো. রিয়াজুল ইসলাম জয় এমবিবিএস ৫৯তম ব্যাচের। বাকি ৫ জন ৬২ তম ব্যাচের। এই ৫ জন হলেন, সাজু দাশ, সৌরভ দেব নাথ, মাহিন আহমেদ, জাকির হোসেন সায়েল ও মো. ইব্রাহিম খলিল সাকিব।
অভিযুক্তদের মাঝে অভিজিৎ দাশকে তিন বছর, মো. রিয়াজুল ইসলাম জয়, সাজু দাশ ও সৌরভ দেব নাথকে দুই বছর করে এবং মাহিন আহমেদ, জাকির হোসেন সায়েল ও মো. ইব্রাহিম খলিল সাকিবকে দেড় বছরের জন্য মেডিকেল কলেজের সকল ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই সাথে তাদের হোস্টেল ও কলেজ ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১৬মার্চ কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। যা ওইদিন (১৬ মার্চ) থেকেই কার্যকরের কথা জানায় চমেক প্রশাসন।
এর আগে ২০২১ সালের ২৯ ও ৩০ অক্টোবর চমেক হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে সংঘটিত ছাত্রলীগের দুগ্রুপের মারামারির ঘটনায় বিভিন্ন মেয়াদে ৩১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে চমেক প্রশাসন। বহিষ্কৃতদের তালিকায় এই সাতজনও ছিলেন। এর মাঝে অভিজিৎ দাশ দুই বছরের জন্য এবং মো. রিয়াজুল ইসলাম জয় দেড় বছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়। আর সাজু দাশ, সৌরভ দেব নাথ, মাহিন আহমেদ, জাকির হোসেন সায়েল ও মো. ইব্রাহিম খলিল সাকিব বহিষ্কার হয়েছিলেন এক বছরের জন্য। এরা ৭ জনই চমেক ছাত্রলীগের একাংশের নেতা–কর্মী এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তবে দুই দফা বহিষ্কার এবং ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণার পরও তাদের দাপট একটুকু কমেনি। হোস্টেল ও ক্যাম্পাস জুড়ে তাদের বিচরণও থামেনি। সদর্পেই ঘুরে বেড়ান তারা। বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদের সরব উপস্থিতি। মাঝে মাঝে চমেক ক্যাম্পাসে শোডাউন দিতেও দেখা যায় তাদের। আর এসবে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় ৫৯ তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ ও মো. রিয়াজুল ইসলাম জয়কে। গতকালও ছাত্রলীগের একাংশের এসব নেতা–কর্মীকে একটি কর্মসূচিতে দেখা গেছে। যেখানে বহিষ্কৃত ও অবাঞ্চিত আরো বেশ কয়জনকে অংশ নিতে দেখা যায়। যদিও এই কর্মসূচি চমেক ক্যাম্পাসের বাইরে পালন করেছে বলে দাবি করেছেন তারা।
অন্যদিকে, অবৈধ ভাবে হোস্টেলের কক্ষও দখলে রাখেন ছাত্রলীগের এই দুই নেতা। ১৬ মার্চ অবাঞ্চিত ঘোষণার পরও তারা হোস্টেলের কক্ষ ছাড়েন নি। অথচ তাদের নামে কোনো কক্ষ বরাদ্দ নেই। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট ঝটিকা পরির্দশনে গিয়ে এই দুজনসহ তিন ছাত্রলীগ নেতার কক্ষ সিলগালা করে চমেক প্রশাসন। পুলিশের সহায়তায় কক্ষ থেকে তাদের মালপত্রও বের করে দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রধান ছাত্রাবাসের ২য় তলার ১২ (বি) কক্ষটি অবৈধ ভাবে দখল করে থাকছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও চমেক ছাত্রলীগের একাংশের নেতা আসেফ বিন তাকি। তিনি সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। আর তৃতীয় তলার ১৭ (এ) এবং ২১ (সি) কক্ষ দুটি দখল করে ছিলেন যথাক্রমে রিয়াজুল ইসলাম জয় ও অভিজিৎ দাশ।
তবে হোস্টেলের কক্ষ দখল করে রাখার বিষয়টি ঠিক নয় বলে দাবি করেছেন ছাত্রলীগের এই দুই নেতা। অভিজিৎ দাশের দাবি– কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে। তিনি কোনও কক্ষ দখলে রাখেননি। ওই কক্ষটি অন্য কারও নামে বরাদ্দ ছিল। আর অবাঞ্চিত ঘোষণার পরও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিতির বিষয়ে অভিজিৎ দাবি করেন– কলেজ ক্যাম্পাসে নয়, তারা হাসপাতালে যান। আর হাসপাতাল চমেক ক্যাম্পাসের অর্ন্তভুক্ত না। তিনি বলেন, আমরা হাসপাতালে যেতেই পারি। সে অধিকার আমাদের রয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে জানিয়ে এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, দু’পক্ষই এসব প্রোগ্রাম করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম বা আমাদের নেতার পক্ষে কোনও প্রোগ্রাম তো আমরা করতেই পারি। যদিও অবাঞ্চিত ঘোষণার পর তেমন কোনও প্রোগ্রামে অংশ নেন নাই বলে দাবি করেন অভিজিৎ দাশ।
তবে নিজে বহিষ্কার হলেও নিজের মালপত্র বহিষ্কার বা অবাঞ্চিত হয় নাই মন্তব্য করে রিয়াজুল ইসলাম জয়ের দাবি– আমাকে বহিষ্কার করা হলেও হোস্টেল থেকে আমার মালপত্র বের করতে হবে, এমন নির্দেশনা তো ছিল না। আর আমি তো আজীবনের জন্য বহিষ্কার না। আবার ব্যাক করবো। তাই আমার মালপত্র সেখানে ছিল। আমার জিনিষপত্রের কি দোষ? শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার করলেও ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সুযোগ নাই বলে মনে করেন রিয়াজুল ইসলাম জয়। আর ‘অবাঞ্চিত’ বলতে কোনও কিছুই নাই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে ক্যাম্পাসে পড়ালেখার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বহিষ্কৃত এ শিক্ষার্থীদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় বলে জানান চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার। অবাঞ্চিত ঘোষণার পরও এসব শিক্ষার্থীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে তারা নজর রাখছেন।
এদিকে, মালামাল বের করে দিয়ে হোস্টেলের কক্ষ সিলগালা করার পর ছাত্রলীগের এই নেতারা কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা ছড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন হুমকি–ধমকি দেয় বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় আসেফ বিন তাকি, রিয়াজুল ইসলাম জয় ও অভিজিৎ দাশের নাম উল্লেখ করে ওইদিনই (২ আগস্ট) চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে চমেক কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে কলেজের কোনও শিক্ষার্থীকে বহিষ্কৃত ও অবাঞ্চিত শিক্ষার্থী/ইন্টার্ন চিকিৎসকের সাথে দলবদ্ধ ভাবে কলেজ ক্যাম্পাসে/হোস্টেলে অবস্থান করতে দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তও নেয় চমেক প্রশাসন। ৫ আগস্ট কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৯ ও ৩০ অক্টোবর চমেক হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে সংঘটিত ছাত্রলীগের দুগ্রুপের মারামারির ঘটনায় বিভিন্ন মেয়াদে ৩১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কৃার করা হয়। ওই বছরের (২০২১ সালের) ২৩ নভেম্বর কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সর্ব সম্মতিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২০২১ সালের এ ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ রেখেছে চমেক প্রশাসন। পরে বহিষ্কৃতদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের শাস্তি স্থগিত করে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হোস্টেলে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তবে তারা ছাত্রাবাসেই থাকতেন। অভিযুক্তরা অবৈধভাবেই ছাত্রাবাসে থাকছিলেন জানিয়ে চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার আজাদীকে বলেন, এদের আগের শাস্তি কিন্তু মওকুফ করা হয়নি। স্থগিত রেখে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। হোস্টেলে তাদের সিট বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অবৈধভাবেই তারা হোস্টেলে রুম দখল করে ছিল। এর মাঝেই এবছর ফেব্রুয়ারিতে তারা আবার ঘটনা ঘটায়। চার শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে। অথচ তারা আর বিশৃঙ্খলা করবে না বলে মুচলেকাও দিয়েছিল। কিন্তু তারা সে মুচলেকাও ভঙ্গ করেছে। নতুন করে অপরাধে জড়িয়েছে। সবমিলিয়ে সর্বসম্মতিতে একাডেমিক কাউন্সিলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট একাডেমিক কাউন্সিলে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবাঞ্চিত এসব শিক্ষার্থীর বিভিন্ন শোডাউন বা কর্মসূচির বিষয়ে খোঁজ–খবর নেয়া হচ্ছে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার।