নারী দিবসের থিম কালার লেভেন্ডার রং–এর শাড়ি পরিহিত একজন নারীর ম্যানিকিন মুখে এক পুরুষ হাতে জুতা নিয়ে তার মুখের কাছে ধরেছে। কি বীর পুরুষ! বীর তো হবেই না, সে এক মস্ত কুলাঙ্গার। সে–আকাশ থেকে উড়ে এই ধরায় এসেছিল। কোনো নারীর জঠরে তার জন্ম হয়নি, কোনো নারী তাকে গর্ভে ৮ মাস বহন করেনি, নিদারুণ প্রসব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাকে পৃথিবীতে আনেননি। কারণ সে যদি একটু ভেবে দেখতো তার জন্মদাত্রীর কথা, তাহলে একজন নারীর ম্যানিকিনে সে জুতা হাতে এই ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতো না। ছবিটি সেদিনই ভাইরাল হলো। নারী সমাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র ঘৃণা আর প্রতিবাদ করেছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক ও উন্নয়ন কর্মী শাহানা হুদা রঞ্জনা ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, এই অপমান ভুলতে পারছি না। দেশে ধর্ষণ আর নারীর প্রতি সহিংসতা কেন বেড়েছে, তা স্পষ্ট। নারীর আব্রু রক্ষার নামে নগ্ন করার এই প্রক্রিয়াকে যারা ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা মনে করে মনে মনে সুখ লাভ করছেন এবং ন্যূনতম প্রতিবাদটুকুও করছেন না, তাদের প্রতি ঘৃণা। বিশেষ করে এনজিও কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী যারা নারীদের জন্য কামাই করে, তারা কেন চুপ? আসলে তো তাই। সেই অন্ধকার যুগ থেকে নারীর মুক্ত অঙ্গনে বেরিয়ে আসতে কত কত যুগ পার হতে হলো। আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিতো, আরো পরে শিশু কিশোরী, বালিকাকে বুড়া লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে স্বামীর মৃত্যুকালে জীবন্ত জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করতো। পাশ্চাত্য দেশেও নির্যাতিত প্রতিবাদী নারী ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও নারী নির্যাতনের ইতিহাসে অত্যন্ত নির্মম এবং চরম হিংস্রতার দর্পণ হিসেবে চিহ্নিত। সেইরকম বহু ঘটনার ধারাবাহিকতায় নারী আজ আধুনিক যুগে এসে অনেকটা সচেতন হয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, স্বাবলম্বী হয়েছে। নিজেরা রোজগার করছে,সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও স্বাধীন জীবনযাপন করছে। তবে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা কমেনি,বেড়েছে। কেবল কি শারীরিক নির্যাতন, ৯৯% ঘরে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার নারী সমাজ। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, নারীদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার কি উপায়? মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি পুরুষই তাদের অজান্তেই রেসিস্ট। মজার ব্যাপার হলো সেই বিশেষজ্ঞও একজন পুরুষ। কাজেই নারী তো তাদের হাতেই নির্যাতিত হবে, হচ্ছেও। কিন্তু প্রতিবাদবিহীন। যখনই প্রতিবাদ এসেছে, তখনই ঘটেছে মারধর, তালাক, এসিড নিক্ষেপ এবং হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ঘটনা। মানসিক যাতনা ও নির্যাতন প্রসঙ্গে ঘরের কর্তা পুরুষটির কথা প্রথমেই বলতে হবে। তিনি তার ঘরণীকে নিয়ে ৪০/৫০/৬০ বছর সংসার করছেন। খুব ভালো কথা। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাদের মানুষ করেছেন, সন্তানেরা বিয়েশাদী করে থিতু হয়েছে। কেউ সাথে থাকে, কেউ বিদেশে (বেশির ভাগ)। এই অবস্থায় কর্তা ব্যক্তির যেমন বয়স হয়েছে, উনার জীবনসঙ্গীটিরও কিন্তু বয়স বেড়েছে, অথচ আমরা কি দেখি, কর্তা ভাবেন, সে তো আমার বিবাহিত স্ত্রী, আমার সব ফরমায়েশ তাকে মানতেই হবে। আমি এই এইটা চাই তো, তাকে সেটি গায়ে গতরে খেটে করে দিতে হবে, আমি এটি খাবো, সেটি খাবো, সবই দিতে হবে। (এখানে আমি আমার চোখে দেখা উচ্চ শিক্ষিত কর্তা ব্যক্তিদের কথাই বলছি)। এর ফলে কি হয়, প্রথমে হয় নারী স্বাস্থ্যের ঝুঁিক। অন্যদিকে এসব নারীরা চরম মানসিক যাতনায় নিপতিত হয়ে অনেকেই হীনম্মন্যতায় ভোগেন। হিংসা আর বিদ্বেষসহ নেতিবাচক বিষয়গুলিই তাদের চেতনায় সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। ফলে চেতনে অবচেতনে প্রবল হিংসাবৃত্তি, সন্দেহভাব, পরশ্রী কাতরতা তাদেরকে গ্রাস করে। অনেক পাগলের দলেই তারা পতিত হন নিজেরই অজান্তে। যাক এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নারীকে হেনস্তা আর অবমাননায় কি করণীয়?
আমাদের দেশে আমরা স্বাধীনভাবেই বাস করছি। নারীরা স্ব স্ব যোগ্যতায় অবদান রাখছে। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন এবং অবমাননা এই যুগে এসে কেন সহ্য করতে হবে? আমরা দেখি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অনেক নারী উপদেষ্টা রয়েছেন। উনারা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। উনারা অতীতে নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করেছেন। নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় উনাদের প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইতিমধ্যে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন কিন্তু সাথে সাথে প্রতিবাদমুখর হন ইসলামী দলগুলো। আর এই প্রতিবাদের কারণেই দেশে আজ নারী সমাজ সহিংসতা, নির্যাতন আর অপমানের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় সচেতন নারী সমাজকে আন্দোলনের ডাক দিতে হবে। নারী সংগঠনগুলোর দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী। আর রাষ্ট্রকে জানাতে হবে নারীদের উপর যেনো কোনো ধরনের অমর্যাদা না হয়। জুলুম, নির্যাতন আর সহিংসতা দমনে এবং নির্যাতনকারীর কঠোর শাস্তি প্রয়োগে রাষ্ট্র যেনো দ্রুত এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে। একই সাথে নারীর প্রতি এই সহিংসতা আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে নারীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।