চট্টগ্রামের যানজট পরিস্থিতি ইদানীং আবারো খারাপ হয়েছে। আগ্রাবাদ এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে’র কারণে যানজট বৃদ্ধি পেলেও শহরে অন্যান্য স্থানে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণেই যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে- যা বলা বাহুল্য মাত্র। যানজটের কারণে দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এক ঘন্টা লেগে যায়। পরিকল্পনা মাফিক সময়কে নিয়ন্ত্রন করা যায় না। ফলে সময়ের কাজ সময়ে করা যায়না, মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
শহরের প্রবেশ মুখ বলে খ্যাত সিটিগেট থেকে এ.কে.খান মোড় ও অলংকার মোড়ে সার্বক্ষণিক যানজট লেগে থাকে। ফেনী থেকে কুমিরা আসতে যতক্ষণ সময় লাগে তারচেয়ে বেশী সময় লাগে সিটিগেট থেকে জিইসি মোড় আসতে। এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশ মুখ বলে খ্যাত কর্ণফুলি ব্রীজের যানজট ইতোমধ্যে দেশব্যাপী খ্যাতিও পেয়েছে। বহদ্দারহাট, কোতোয়ালী হতে গাড়ি গুলো গিয়ে ব্রীজের গোলচত্বর গিয়ে আটকে যায়। কর্ণফুলি ব্রীজের গোলচত্বরে যেন দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়ি সমূহের ইচ্ছেমত যানজট সৃষ্টি করার লাইসেন্স প্রাপ্ত মাঠ। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী বাস সমূহ রাস্তায় এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ সাহেবরা অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন। সেখানকার যাত্রীবাহী বাস সমূহ কোন কিছুকেই কেয়ার করে না, ফলে অন্যান্য যানবাহন গুলো অসহায়ের মত ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। একই অবস্থা নগরীর আর দুটি প্রবেশ পথ বহদ্দারহাট ও অঙিজেন এলাকায়ও দেখা যায়। অক্সিজেন গোল চত্বর পার হতে ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট লেগে যায়। অক্সিজেন মোড়ের যানজট দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে মানুষের কষ্টও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বহদ্দারহাট মোড়ের দৃশ্য সবচেযে বেশি ভয়াবহ। ফ্লাইওভার আছে, কিন্তু গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে যায় না। সিডিএ এভিনিউ, চকবাজার, বাস টার্মিনাল রোড, কর্ণফুলি ব্রীজ সংযোগ সড়ক, চাঁনমিঞা সড়ক সব দিকের গাড়ি আর রিঙার চাপে বহদ্দারহাট চ্যাপ্টা হয়ে আছে। ইদানীং ফ্লাইওভারের সংযোগ র্যাম্পে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করার কারণে যানজট আরও বেড়েছে। বহদ্দারহাট থেকে পুরাতন চান্দগাঁও থানা পর্যন্ত ওয়াসার কাজের কারণে প্রতি দিনেই মানুষ দীর্ঘ যানজটে ভোগানির শিকার হচ্ছে। তার উপর আছে ভাসমান হকার। ফুটপাতের দোকানের বৈধতা পাওয়া গেলেও এখন ফুটপাত জুড়ে আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসিয়েছে ‘বিরিয়ানি’ আর ‘ফলমূলের’ দোকান। যা থেকে প্রতিদিন চাঁদাবাজি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে বেচারা পথচারিদের হাঁটার জায়গা নাই। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা রাস্তায় হাঁটেন। আর ওদিকে যানজট আরও বাড়ে। বহদ্দারহাট মোড়ের যানজটের অরাজক চিত্র স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। রাস্তা তৈরী করা হয়েছে যেন হকারদের ব্যবস্থা করার জন্য। নতুন চান্দগাঁও থানার সামনে কঙবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী বিশাল বিশাল চেয়ার কোচ সমূহ এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে থেকে উক্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত অসহনীয় যানজট সৃষ্টি করে। এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরী করে। যা দ্রুত সমাধান করা উচিৎ। থানার কাছাকাছি ‘করম পাড়ার’ মোড়েও প্রতিদিন সন্ধায় মারাত্মক সৃষ্টি হয়। যা সমাধানের জন্য কেউ উদ্যোগ নেয় না। যা দূঃখজনকই বটে।
শহরের প্রবেশ মুখ ছাড়াও মুরাদপুর, ষোলশহর-দুই নম্বর গেট, জিইসি মোড়, আন্দরকিল্লা, টেরিবাজার, কোতোয়ালী মোড়, রিয়াজ উদ্দিন বাজার আমতল, নিউমার্কেট, ষ্টেশন রোড, দেওয়ানহাট, কদমতলী, বড়পুল, গোলপাহাড়, প্রবর্তক, চকবাজার, তেলপট্টি, গোলজার মোড়, অলিখাঁ মসজিদ মোড়, প্যারেড কর্ণার মোড় প্রভৃতি এলাকার যানজট ইতোমধ্যে নগরবাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আগ্রাবাদ ও ইপিজেড মোড়ের যানজট তো ঐতিহাসিক হতে চলেছে। বিদেশগামী অনেক যাত্রী শুধুমাত্র এই দুই মোড়ের যানজটের কারণে যথাসময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছতে না পেরে, বিদেশ যেতে পারেন না।
শহরের যানজট পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে খুবই কষ্ট হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের বিশাল ট্রাফিক বিভাগ থাকা সত্বেও কেন নগরবাসীকে যানজটে আটকে থেকে নাকাল হতে হচ্ছে? এই যানজটের কারণে হাজার হাজার মানুষের শত শত শ্রমঘন্টা নষ্ট হচ্ছে, শত শত লিটার জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে। গাড়ি হতে নির্গত ধোয়ায় বাতাস দূষিত হচ্ছে, ফলে রোগ ব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে।
যানজট পরিস্থিতি লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখা গেছে, মূলত শহরের বিভিন্ন রাস্তার ‘মোড়’ সমূহে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রয় না থাকার কারণেই যানজটের অবনতি হচ্ছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, একটা ‘মোড়’ যেন একটা অসভ্যতার চিত্র। মোড়ের অর্ধেক এলাকা জুড়ে রিঙা-টেঙি দাঁড়িয়ে থাকে। মোড়ে কিছু অংশ দখল করে রাখে হকার’রা। কিছুদিন হতে প্রতিটি মোড়েই সবজি, বিরিয়ানি, চটপটি, ভাপা পিঠা, চা বিক্রেতা, সিদ্ধ ডিম বিক্রেতাদের ভ্রাম্যমান দোকান দেখা যাচ্ছে। রিঙা-টেঙি ও ভাসমান দোকানের কারণে শহর এলাকার যাত্রীবাহী বাস-হিউম্যান হলার গুলো বলতে গেলে রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ যানজটের উৎপত্তি হয়। তাছাড়া বাসের জন্য অপেক্ষামান যাত্রীরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বাসগুলোও অপেক্ষমান যাত্রীদের টার্গেট করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে পেছনের গাড়ি আর যেতে পারে না। এই দৃশ্য শহরের প্রতিটি মোড়েই প্রতিনিয়ত দেখা যায়। কিন্তু কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ বা সার্জেন্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না।
একটি বিষয় লক্ষ্য করলে সহজে বুঝা যাবে যে, ট্রাফিক (গ্রীন) সিগন্যাল পাওয়ার পর যদি গাড়ি গুলো দ্রুত বা দ্রুত গতিতে মোড়’ পার হয়ে যেতে পারতো তাহলে যানজট ৫০% কমে যেতো। এই সাধারণ বিষয়টি ট্রাফিক বুঝেন বলে মনে হয় না এখন দেখা যায় গ্রীন সিগন্যাল পাওয়ার পরও গাড়ি গুলো যানজটের কারণে মোড় পার হতে পারে না, ফলে মোড় পার হওয়ার জন্য অপেক্ষমান গাড়ির পেছনে গাড়ির সারি আরও বাড়তে থাকে। আমরা আরও লক্ষ্য করেছি যে, মোড়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনস্টেবলগণ অনেক সময় যানজট লেগে থাকা সত্বেও বাস-ট্রাক দাঁড় করিয়ে কাগজ পত্র চেক করার নামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে যানজটও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
শহরের যানজটে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিম্নোক্ত কিছু বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে যানজট ৭০% কমে যাবে। যেমন- (ক) শহরের চৌরাস্তা বা সাধারণ মোড়ে বা মোড় ঘেষে কোন যাত্রীবাহী বাস, টেঙি, রিঙা, হিউম্যান হলার দাঁড় করানো যাবে না। কোন অপেক্ষমান যাত্রী মোড়ে, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে না। যাত্রী, যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যান সমূহকে মোড় হতে কমপক্ষে ২০০ গজ দূরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। মোড়ের রাস্তায় রং দিয়ে চিহ্নিত করে দিতে হবে যাতে গাড়ি বা যাত্রী না দাঁড়ায়। পুরো বিষয়টি ট্রাফিক বিভাগকে ১০০% নিশ্চিত করতে হবে এবং মনিটরিং করতে হবে। কোন গাড়ি বা যাত্রী যদি নিয়ম ভঙ্গ করে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সে ক্ষেত্রে জরিমানা করতে হবে। তাহলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। (খ) শহরের রাস্তার প্রতিটি মোড়কে যে কোন মূল্যে বিরিয়ানী, চটপটি, ফুসকা, ডিম, সবজি বিক্রেতা তথা হকার মুক্ত করতে হবে। হকাররা নিরাপদ দূরত্বে তথা মোড় হতে ৫০০ গজ দূরে প্রশস্ত রাস্তা দেখে তাদের পসড়া সাজাতে পারবে। (গ) রাস্তার পাশে যাত্রিবাহী গাড়ি দাঁড়ানোর জন্য রশি দিয়ে বা রং দিয়ে অস্থায়ী ট্র্যাক এঁকে দিতে হবে। যেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করবে। সম্ভব হলে রাস্তার পাশে ‘বাস বে’ তৈরী করে দিতে হবে। ট্র্যাকের বাইরে বা ‘বাস বে’র কোন যাত্রী বাস-টেম্পো দাঁড়াতে পারবে না। (ঘ) শহরের ফুটপাত সমূহ দখল মুক্ত করতে হবে। যাতে পথচারীদেরকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে না হয়। পথচারীরা রাস্তা দিয়ে হাঁটার কারণেও যানজটের অবনতি হয়। (ঙ) মোড়ের মধ্যে ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনষ্টেবলরা কোন গাড়ির কাগজপত্র চেক করবেন না। যাঁরা মোড়ে দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁরা শুধুই যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং যানজট যেন না হয়-তা নিশ্চিত করবেন। গাড়ির কাগজপত্র চেক করার জন্য শহরের মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত রাস্তায় পৃথক ভাবে সার্জেন্ট ও কনষ্টেবলকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে, যারা শুধু যানবাহনের কাগজপত্র চেক করবেন।
(চ) শহরের ভিতরে যানজট কবলিত কয়েকটি স্থানে রাস্তার মাঝখানে ‘রোড ডিভাইডার’ দিলে সে সব স্থানে যানজট হবে না। যদি গাড়িগুলোকে চৌরাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে রাস্তা পারাপারকারি গাড়ি গুলোকে কিছুটা সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার করানো হয়, তাহলে সেসব স্থানে যানজট থাকবে না (পটিয়া উপজেলার শান্তির হাটেও এধরনের ডিভাইডার দেয়া জরুরি। কারণ সেখানেও কঙবাজারগামী হাইওয়ের যানবাহন যানজটে আটকে যায়)। (ছ) ইপিজেড মোড়ের যানজট নিরসনের জন্য বিমান বন্দরগামী গাড়ি গুলোকে নৌবাহিনীর অভ্যন্তরীন রোড দিয়ে চলাচল করতে দেয়া এবং ইপিজেড-এর বাস গুলো পেছনে নতুন রাস্তা তৈরী করে দু’দিকে ভাগ করে প্রবেশ ও বের করানো। (জ) বন্দরের ট্যাংক, লরি গুলো দাঁড়ানোর জন্যও পৃথক স্থান নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই ট্যাংক লরির কারণে সে রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। (ঝ) পথচারিদের রাস্তা পারাপারে শৃংখলা আনাও জরুরী। ট্রাফিক বিভাগ যানবাহনের পাশাপাশি পথচারীদেরকেও সুশৃংখল ভাবে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পরামর্শ দেবেন এবং বাধ্য করবেন। তাছাড়া প্রতিটি মোড়ে ‘জেব্রা ক্রসিং’ দেয়াও জরুরি। শহরের যানজট পরিস্থিতি যে কোন সময়ের চেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা বলা বাহুল্য মাত্র। যানজট পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ট্রাফিক বিভাগকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করবো, ট্রাফিক বিভাগ, সিএমপি, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, বিআরটিএ, বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সম্মিলিত ভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে যানজট হতে নগরবাসিকে মুক্তি দেবেন।
লেখক : কলামিষ্ট, সমাজকর্মী