পরিমল সাহা ছিলেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতা। একে খান শিল্পগোষ্ঠীর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরউদ্দিন খান যখন (১৯৭৫–৭৮) চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি, তখন পরিমল সাহা ছিলেন প্রথম সহ–সভাপতি (বর্তমানের সিনিয়র সহ–সভাপতি)। চেম্বারে যাঁরা নেতৃত্ব করেছেন, তাঁরা সব সময় চেম্বারের সভাপতি হতেন না। কথাটা ঘুরিয়েও বলা যায়, ব্যবসায়ীদের অভাব–অভিযোগ, দাবি–দাওয়া, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করতেন, তাঁরা সবাই চেম্বার নেতা নন; ট্রেড বডির নেতা বললেই তাদের যথাযথ পরিচয় জ্ঞাপন হয়। যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নেতা মওলানা ইসলাম, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা ইব্রাহিম চৌধুরী, বজলুর রহমান চৌধুরী, তমিজ মার্কেটের কুদ্দুস সাহেব, পুরান কাপড়ের ব্যবসায়ীদের নেতাও কেউ ছিলেন। সম্ভবত অধ্যক্ষ ওয়াজিউল্লাহ ভূঁইয়া।
পরিমল সাহা ব্যবসায়ী যেমন, তেমনি ব্যবসায়ী নেতা বা চেম্বার নেতাও ছিলেন। তাঁর মাথাটি ছিলো ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ঠাসা। ব্যবসা–বাণিজ্যের জ্ঞানে বোঝাই এক অদ্ভুত মস্তিষ্ক। সেজন্য সমসাময়িক ব্যবসায়ী নেতারা বলতেন, পরিমল সাহা মারা গেলে তাঁর ব্রেইনটি তাঁরা সংরক্ষণ দেখবেন, সৃষ্টিকর্তা কি বিশেষ উপাদান দিয়ে তা তৈরি করেছিলেন। এমনি চমৎকার বাণিজ্য বুদ্ধির আরেকটি উদাহরণ আমি যার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি, তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার ড. ছানাউল্লাহ’র জামাতা ও হাতি কোম্পানির নাতি এবং ব্যারিস্টার আনিস ও ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদের পিতা সিরাজুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র পাকিস্তানে সর্বপ্রথম এশিয়াটিক কটন মিল প্রতিষ্ঠা করে এই অঞ্চলে শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত হন। তিনি উক্ত কটন মিলের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৫১–৫৭ পর্যন্ত চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (বর্তমান চেম্বার নয়, ইউরোপিয়ান চেম্বার অথবা আগ্রাবাদ চেম্বার) অনারারি সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান চেম্বার জাপানে আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের সাথে সাক্ষাৎ করে। সিরাজুল ইসলাম মাহমুদ একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি রয়েল এয়ারফোর্সের পাইলটও ছিলেন। কত আধুনিক। যখন পাইলটের সংখ্যা হাতে গোণা যেত, তখন সিরাজুল ইসলাম মাহমুদ একজন পাইলট ছিলেন।
পরিমল সাহার পিতা যামিনী কুমার সাহা মণ্ডল এবং মাতা তীর্থবাসী সাহার চার পু্ত্র ও এক কন্যা, মোট পাঁচ সন্তানের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রী পরিমল সাহা জন্মগ্রহণ করেন নোয়াখালি জেলার সুধারাম (সদর, বর্তমান : কবির হাট) থানার দক্ষিণ নরোত্তমপুর গ্রামে, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতামহ রাধাকৃষ্ণ মণ্ডল উক্ত এলাকার প্রতাপশালী সমাজপতি ছিলেন।
গ্রামের স্কুলে কিছু সময় লেখাপড়া করার পর পরিমল সাহার পিতা তাঁকে তাঁদের গ্রামের অনতিদূরে অবস্থিত বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র বেগমগঞ্জ থানার চৌমুহনীতে তাঁর মাতুলালয়ে প্রেরণ করেন। চৌমুহনীতে মামার বাড়ি এবং পিসির বাড়িতে অবস্থান করে তিনি চৌমুহনী অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে, বিশেষ করে চৌমুহনী মদন মোহন হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। স্কুলে পড়াকালীন এলাকায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। কিশোরকালে একইসাথে প্রচণ্ড দুষ্টু হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর।
পিতা এবার তাঁকে উপরের ক্লাসে পড়ার জন্য চট্টগ্রাম প্রবর্তক সংঘ স্কুলে প্রেরণ করেন। প্রবর্তক সংঘ স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন শিক্ষক কর্তৃক এক ছাত্রকে বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত করার দৃশ্য দেখে তিনি এক কাপড়ে চৌমুহনীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং লেখাপড়ায় ইস্তফা দেন।
ইতিমধ্যে চৌমুহনীতে তাঁর পিতার ব্যবসাও মন্দাক্রান্ত হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাঁধেই এসে চাপে সবার ভরণপোষণের ভার। কতই বা বয়স তখন তাঁর, কৈশোরের গণ্ডি পেরোনো তরতাজা তরুণ। বিশ্বজুড়ে চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, বাংলায় দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ; এমনি ভীষণ নষ্ট সময়ে একটি পরিবারের মুখে আহার্য যোগানোর গুরুদায়িত্ব নিয়ে পরিমল সাহার বিস্ময়ে বিমূঢ় অবস্থা। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা পরিচালনার এক পর্যায়ে বন্ধু চিত্ত রঞ্জন সাহা (মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশে বইমেলার পথিকৃৎ) সহ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ‘পুথিঘর‘ নামীয় পুস্তক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প কিছুকাল পর অংশীদারত্বের ব্যবসা ত্যাগ করে তিনি ‘গ্রন্থালয়‘ নামে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুস্তক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে পুস্তক ব্যবসা ত্যাগ করে তিনি অন্যান্য ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি মধ্য–পঞ্চাশের দশকে তিনি ‘অন্নপূর্ণা অয়েল মিল‘ নামীয় ভোজ্য তেলের শিল্প–কারখানা গড়ে তোলেন।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জ্যোৎস্না রাণী সাহার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ষাটের দশকের গোড়ায় চৌমুহনীতে ‘ডেল্টা জুট মিল‘ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন, তখনকার গভর্নর আজম খানের ব্যক্তিগত সমর্থনে।
তাঁর নেতৃত্বে চৌমুহনীতে ‘মিকাডো ক্লাব‘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠিত হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে চৌমুহনী পাবলিক হলে মিকাডো ক্লাবের আয়োজনে চৌমুহনী কলেজের তখনকার ইংরেজির তরুণ শিক্ষক, বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার অভিনীত একাঙ্কিকা ‘এক পেয়ালা কফি‘ তখনকার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে আতাউর রহমান খান এবং ভাষা সংগ্রামী অলি আহাদের মতভেদের কারণে রাজনৈতিক দল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। অলি আহাদের সভাপতিত্বে ‘জাতীয় লীগ‘ গঠিত হয়। শ্রী পরিমল সাহা কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে অলি আহাদের সভাপতিত্বে জাতীয় লীগের সভায় তিনি জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে ভাষণ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোলকাতায় অবস্থান করে বন্ধু এম. আর. সিদ্দিকীর সান্নিধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। সদ্য–স্বাধীন দেশে ভাষা সংগ্রামী অলি আহাদের রাজনৈতিক ভূমিকায় তাঁর সাথে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়ায় সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার গভর্নর বন্ধু জাকেরুল হক চৌধুরীর লালদিঘীর আমানিয়া হোটেলে প্রাক্তন সংসদ সদস্য ডা. বি.এম. ফয়জুর রহমান, প্রাক্তন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, প্রাক্তন সংসদ সদস্য মির্জা আবু মনসুর সহ অন্যান্য বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে সান্ধ্য– রাজনৈতিক আড্ডায় মিলিত হতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ‘Edible Oil Importers Association গঠন করে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সদ্য–স্বাধীন দেশের বিশৃঙ্খল বাণিজ্যিক অঙ্গনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বন্ধু বাণিজ্য মন্ত্রী এম. আর. সিদ্দিকীসহ সদ্য–স্বাধীন দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পুনর্গঠনে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। তিনি মধ্য–সত্তর দশকে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির ভাইস–প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সুদীর্ঘকাল তিনি চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র ভাইস–প্রেসিডেন্ট–এর পদ অলঙ্কৃত করেন। তাঁর নেতৃত্ব এবং ভূমিকায় চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি দেশের শিল্প ও বাণিজ্য অঙ্গনে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় ‘ট্রাস্টি বোর্ড‘ গঠনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রীজ গঠনেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি দীর্ঘদিন ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্র্রিতে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি নোয়াখালি সমিতি, চট্টগ্রাম–এর সভাপতি ছিলেন।
দেশ গড়ার কাজে বিভিন্ন সময় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, স্পীকার আবদুল মালেক উকিল, মন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সদ্য–স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সারাদেশে একসাথে দুর্গা পূজা ভেঙে দেয়ার প্রতিবাদে তাঁর নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকে প্রশাসনিক ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর নিকট উষ্মা প্রকাশ করেন। বাঙালি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক পুঁজি গঠন এবং দেশের বাণিজ্য ভুবনে সততা প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্য–পঞ্চাশ দশক থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত তিনি তাঁর মেধার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
প্রায় তিন দশক দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েও ব্যক্তি জীবনে তিনি শতভাগ সৎ থেকেছেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান, ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার প্রাক্তন সভাপতি, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক অধ্যাপক অশোক সাহা বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পেশায় ব্যবসায়ী দ্বিতীয় সন্তান অনুপ সাহা, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রী সমিতি, শিশুদের শিক্ষা–সংস্কৃতি সংগঠন ‘ফুলকি’র ট্রাস্টি বোর্ডের স্থায়ী–সদস্য সহ অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃৃতিক সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। তৃতীয় সন্তান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অসীম সাহা, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া সংগঠন ‘ফ্রেন্ডস্ ক্লাব‘ এবং নাট্য সংগঠন ‘থিয়েটার ‘৭৩‘-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে বসবাস করেন। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান, একমাত্র কন্যা নজরুলগীতি শিল্পী টিঙ্কু সাহা ত্রিশ বৎসরোর্ধ কাল আমেরিকার ওয়াশিংটনে বসবাস করছেন। তিনি দীর্ঘদিন আমেরিকান ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন–এ কর্মরত আছেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর স্ত্রীও মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক।