
অপু বড়ুয়া একজন বহুমাত্রিক লেখক। লেখালেখির অনেক শাখায় তাঁর গৌরবদীপ্ত বিচরণ আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও পেশাগত কাজের কাজের বাইরে তাঁর মননশীল ও সৃজনশীলতা চর্চার কোনো ঘাটতি নেই। ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গান, গল্পসহ নানামুখী লেখালেখিতে তাঁর পারঙ্গমতা চমৎকার। দেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ছড়া সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এক সময় ছড়াকে সাহিত্য হিসাবে তেমন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ছড়া হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। ছড়াকে বলা হয় সমাজ বদলের হাতিয়ার। ছড়ার শাণিত শব্দ পাঠকের মনে সৃষ্টি করে ভাবনা। সেই ভাবনা হতে পারে সমাজের জন্য ইতিবাচক বা জাগতিক কোনো অসংগতির বিষয়ের নেতিবাচক ধারণাও। অর্থাৎ ছোট্ট একটি ছড়ার মাধ্যমেই মানুষের মনে একটি জাগরণ সৃষ্টির শক্তি সঞ্চারিত হয়, যদি ছড়াটি সেই রকম ছন্দ নৈপুণ্য ও কথার গাঁথুনিতে সে রকমের হয়। সেজন্য ছড়া ছোট বড় সকলেরই প্রিয় হয়ে থাকে। আর ছড়া বরাবরই ছোটদের প্রিয় হয়, কারণ তার পড়ার পাঠশালাটা ছড়া দিয়েই তৈরি হয়। অপু বড়ুয়ার প্রায় ৩০টির মত প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছড়া কবিতার বই। এতেই বুঝা যায় অপু বড়ুয়া ছড়া–কবিতার এক অন্তঃপ্রাণ মানুষ। ২০২৫ সালে ঢাকার বাবুই প্রকাশন থেকে বের হয়েছে তাঁর শিশুতোষ ছড়ার গ্রন্থ ‘বিশটি ছড়াই মিষ্টি’। বইটির প্রতিটি ছড়ায় রয়েছে ছড়াকারের কুশলী হাতের ছাপ। দেশের পত্রপত্রিকায় ছড়া লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেজন্য ছড়া লেখার ক্ষেত্রে তাঁর একটু সুবিধা হয় ছন্দ, শব্দ চয়ন ও কথার বৈচিত্র্য আনয়নে। শিশুতোষ ছড়া নির্মাণে আলাদা একটা প্লট বা ভাবনা মাথায় রেখে ছড়া রচনায় মনোনিবেশ করতে হয়। ‘বিশটি ছড়াই মিষ্টি’ ছড়ার বইয়ের ক্ষেত্রে ছড়াকার অপু বড়ুয়া সে ভাবনাকে যতটুকু প্রসারিত করে ছড়া রচনা করা যায় তার স্পর্শ ছড়াগুলোতে রেখেছেন। ‘আঁকার ভাষা লেখার ভাষা/ চাওয়ার ভাষা পাওয়ার ভাষা/ মনের ভেতর জাগায় আশা/ বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা (ছড়া–বাংলা ভাষা), ‘দেখতে গোলাপ কুঁড়ি/ সে আমাদের বুড়ি/ বুড়ির বয়স দুই/ নামটি খুকুর জুঁই।(ছড়া – নামটি খুকুর জুঁই), খোলা মাঠে কেউ হাসে করে লুটোপুটি/ ছুটি হলো পাঠশালা ছুটি’(ছড়া–ছুটির ঘণ্টা)- ছড়ার বইটির এগুলো প্রথম দিকের তিনটি ছড়ার উদাহরণ। শিশুরা সাধারণত যে ভাবনায় তাড়িত হয় সেগুলোকে মাথায় রেখে চমৎকারভাবে ছড়ার পঙ্ক্তি সাজানো হয়েছে। প্রথম দুটি ছড়াতে স্বরবৃত্তের চাল আছে পরের ছড়াটিতে মাত্রাবৃত্ত ঘরানার চাল লক্ষণীয়। নিটোল শিশুতোষ ছড়ার বৈশিষ্ট্যে বইয়ের প্রায় সব ছড়াই সুখপাঠ্য। ‘সূর্য’ নামের ছড়ায় ছড়াকার ছড়ার শেষ দিকে বলছেন, ‘সূর্য আছে সূর্য থাকুক সূর্য উঠুক পুবে/চাঁদটি ছড়াক স্নিগ্ধ আলো সূর্য গেলে ডুবে।’ স্বরবৃত্ত ছন্দে ছড়াকারের কী সুন্দর শিশুতোষ ভাবনা। স্বাধীনতা, এসো খোকা এসো খুকি, একুশ আমার নামের ছড়াগুলোতে ছড়াকারের স্বদেশপ্রেমের যে প্রকাশ তা স্বতঃস্ফূর্ত। দেশপ্রেম শিশুদের মনে জাগ্রত করার প্রয়াসে ছড়াকার অপু বড়ুয়া শব্দমালার চমৎকার বিন্যাসে যে ছড়া রচনা করেছেন তা শিশুতো বটেই সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে ভালোলাগার অনুষঙ্গ হতে পারে। ছড়া যে শুধু শিশুরা পড়ে তা নয়, সব শ্রেণির পাঠকে কাছে তা হতে পারে প্রিয় একটি বিষয়। আমাদের শিশুদের চমৎকার একটি চরিত্র নির্মাণের প্রয়াস দেখি ‘আমাদের শিশুরা’ নামক ছড়াতে। ‘শিশুরা পক্ষী শিশুরা ফুল/ শিশুরা করে না কখনো ভুল/ শিশুরা হাসবে শিশুরা কাঁদবে/ শিশুরা বাঁধাবে হুলুস্থুল।’ আসলেই এটাই যেন শিশুদের প্রকৃত চরিত্র। শিশুরা ফুলের মত, শিশুরা কখনো ভুল করতে পারে না – শিশুদের সম্পর্কে এ চমৎকার পর্যবেক্ষণ শিশুদের কাছেও ভালো লাগবে। বাবা এবং মাকে নিয়ে তাঁর দুটো ছড়া আছে বইতে। ছড়াগুলো পড়ে শিশুরা আনন্দ পাবে বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসা বা অনুরাগে শিশুমন ভরে উঠবে। ছড়ার ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত। স্বরবৃত্ত ছন্দের চার চার মাত্রার তিন পর্বের ও দুই মাত্রার একটি ভাঙা পর্বের দোলা পাঠককে দোলায়িত করবেই। ‘বাঘরাজা’ নামের ছড়ায় বাংলাদেশের জাতীয় ফুল, ফল, বৃক্ষ, মাছ ও পশুর কথা ছড়াকার যেভাবে ছন্দে গাঁথলেন শিশুরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিজেরাই অনুধাবন করতে পারবে। ‘ফুলকন্যা’ ও ‘প্রজাপতি’ নামের ছড়া দুটোও চমৎকার। চারমাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ছড়াকারের বুননশৈলী নান্দনিক। ‘প্রজাপতি লাল নীল ঝিলিমিলি ডানা/নেচে নেচে উড়ে যেতে নেই কোনো মানা’ (ছড়া–প্রজাপতি), ‘সন্ধ্যায় মালা বেচে কিছু যদি পায়/তাই দিয়ে একবেলা আহার জোগায়‘’ (ছড়া–ফুলকন্যা)। খুব সহজ সরল ভাষার শব্দ চয়নে শিশুমনষ্ক ভাবনাগুলো শিশুদের মনে ছড়িয়ে দেবার প্রবণতা ছড়াকারের ছড়ায় বেশ প্রাঞ্জলভাবে উপস্থিত। খুব ছোট ছোট বাক্য বিন্যাসে ছড়ার নির্মাণ প্রশংসার দাবীদার। স্বরবৃত্ত ছন্দের গাঁথুনিতে ছড়াগুলোতে আমাদের আবহমান বাঙালির অনেক ঐতিহ্য ধরা দিয়েছে। যেমন মেলা, পুতুলখেলাসহ নানা ধরনের প্রকৃতি বিষয়ক চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘একটি বাংলাদেশ’ নামের চমৎকার একটি স্বদেশ প্রেমের ছড়া এবং ‘নীল পাহাড়ের ভূত’ নামে একটি মজাদার রূপকথা ঘরানার ছড়াও আছে বইতে। সব মিলিয়ে বলা যায় বিশটি ছড়াই মিষ্টি ছড়া। বইটির প্রচ্ছদ ও ভেতরের অলংকরণ করেছেন শিল্পী নিসা মাহ্জাবীন। মূল্য ১৫০ টাকা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ; গীতিকার,
প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক।












