সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে অপুষ্টির হার, মা ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কমেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে খর্বকায় ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যাও কমেছে। এর বিপরীতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। আজ থেকে ৩০–৪০ বছর আগে আমাদের দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার সংখ্যা ছিল বছরে গড়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩৭টি। দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদিত হচ্ছে বছরে প্রায় ৬ কোটি ৬৮ লাখ। ২০৩১ সাল নাগাদ ডিম খাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বছরে জনপ্রতি ১৬৫টি।
২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের জিডিপিতে অবদান ১.৮১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৯ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপির মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫৪ শতাংশ, যা সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব প্রতিফলিত করে। বর্তমানে দেশে প্রায় আড়াই কোটি গরু, ১৫ লাখ মহিষ, ৩ কোটি ছাগল–ভেড়া এবং ৪০ কোটি হাঁস–মুরগি রয়েছে। এসব গবাদিপশু ও হাঁস–মুরগির উৎপাদনের মাধ্যমে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে ১৫৫ লাখ মেট্রিক টন দুধ, ৮৯.৫৪ লাখ মেট্রিক টন মাংস এবং ২৪৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। পরিসংখ্যানে আরো জানা যায়, বাংলাদেশে এ খাতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। মাত্র চার যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর এ খাতটি এখন অনেকটাই আত্মনির্ভরশীলতার দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, এক দিন বয়সি বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। সাধারণ গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে প্রাণিজ আমিষের জোগান দিচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশের প্রান্তিক খামারিরা এখনও মোট ডিম উৎপাদনের বড় অংশ জোগান দিয়ে থাকে।
বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্প বিকাশে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে পোল্ট্রি ফিডের উচ্চমূল্য। এ কারণে অনেক প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি আশানুরূপ মুনাফা করতে না পারায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক জনসংখ্যার এ দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা। কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য এ সমস্যা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে, সন্দেহ নেই। এর কৃতিত্ব মূলত কৃষকদের। তারা যাতে এক্ষেত্রে আরও সাফল্য অর্জন করতে পারেন, সেজন্য সরকারের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, ক্ষেত্রবিশেষে এ সহায়তা আরও বাড়াতে হবে। এ জন্য কৃষিজাত খাদ্য উৎপাদনে জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক এবং বেসরকারি প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। ক্ষুধা সমস্যা সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অংশের বসবাস এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মারাত্মক অপুষ্টি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে এবং প্রায় সব বয়সী মানুষের ওপরেই অপুষ্টির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে এবং তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অঞ্চলে ৭ কোটি ৯০ লাখ শিশু বা পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি চার শিশুর একজন খর্বাকৃতির সমস্যায় ভুগছে এবং ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুর জীবন অকেজো হয়ে যাচ্ছে, যাদের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ভয়াবহভাবে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও গত দশকে শিশুর খর্বাকৃতির সমস্যা নিরসনে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে শিশুর জীবন অকেজো হয়ে পড়া ঠেকাতে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে।
অপুষ্টি নিরসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও এটি সারা বিশ্বেই একটি ভয়াবহ সমস্যা। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি যেন ঝুঁকির মধ্যে না থাকে, তার জন্য মনোযোগ বাড়াতে হবে। কেননা, সুস্থ–সবল জাতি গঠনে পুষ্টির বিকল্প নেই। অপুষ্টি দূরীকরণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, সঠিক নিয়মে হাত ধোঁয়া খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বত্র সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।