অপারেশন সার্চলাইট, ব্লাক আউট ও গণহত্যার সেই ভয়াল কাল রাতের স্মৃতি

প্রফেসর হোসাইন আহমেদ আরিফ ইলাহী | শুক্রবার , ২৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

২৫ মার্চ ১৯৭১:
সেই ঐতিহাসিক দিন ও তারিখের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব বয়স কম থাকার কারণে আমার বুঝে উঠার সামর্থ্য তখনও হয়নি, তথাপি অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে সেই নারকীয় ও নৃশংসতম গণহত্যার রাতের স্মৃতি তথা ১৯৭১ এর যুদ্ধ- বিক্ষুব্ধ শৈশব কাল অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ, ভয়াবহতা ও বিজয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে আজীবন ধন্য ও গর্বিত মনে করে যাব এবং মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত মহানায়ক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ও অর্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার দেখা বিষাদময় ও ভয়ার্ত স্মৃতিগুলো আমরণ লালন ও বয়ান করে যাব। আব্বার চাকুরীর সুবাদে আমরা তখন চট্টগ্রাম বন্দর হাইস্কুলের অদূরে মার্কেটের পাশের একটা চারতলা ভবন এ থাকতাম । সেখানে মোট আট বাঙালি পরিবার থাকতো এবং আমরা নিচের ফ্লাটে থাকতাম। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের পিতা জনাব মিসবাহ উদ্দিন আহমদ সাহেব চট্টগ্রাম বন্দরে আমার আব্বার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন এবং তাঁর ছোটভাই ইয়ামিন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। জনপ্রিয় কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের বড়বোন বন্দর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুরাইয়া খালাও আমাদের উপরের ফ্লাটে থাকতেন।
যেভাবে হলাম সেই ভয়ংকর রাত্রির যাত্রী :
১৯৭১ সালে আমি ছিলাম পাঁচ বছরের শিশু এবং চট্টগ্রাম বন্দর প্রাইমারি স্কুলের ১ম শ্রেণির ছাত্র। সাধারণত বিকেল বেলা বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে যাওয়ার আগে আম্মার নির্দেশে এক চিলতে বিড়াল ঘুম যেতে হতো। অন্যান্য দিনগুলোর মতো সেদিনও বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে যাওয়ার আগে দুপুরের খাবার খেয়ে যথারীতি আম্মার সাথে ঘুমোতে যাই। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বালিশের পাশের জানালা (যেটা রাস্তার মুখোমুখি) বন্ধের শব্দে আমার অপূর্ণ ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখি, আম্মা আতংকিত হয়ে নিঃশব্দে প্রাণপনে জানালার হুকগুলোকে আটকাতে তৎপর এবং আব্বা এসে চাপা স্বরে আপাদের সবাইকে তাড়াতাড়ি অন্য রুমগুলোর সব জানালা ও সদর দরজা বন্ধ করে নিচে বসে থাকতে বলেন। কারণ নিচের ফ্লাটে ছিলাম থাকার কারণে আপারা দৌঁড়ে এসে আব্বাকে জানাল, ওরা নাকি দেখতে পেয়েছে আমাদের ফ্লাটের চারদিকে পাকিস্তানি আর্মি এসে ঘেরাও করে ফেলেছে। আব্বাকে আরো জানালো, আমাদের ফ্লাটের কলাপসিবল গেইট খোলা রয়েছে এবং বড় ভাই ও তার বন্ধু ছাদে গেছেন। এ খবর শুনা মাত্রই আব্বা -আম্মার টেনশন আরো বেড়ে গেল। আব্বা আল্লাহ্‌আল্লাহ্‌করতে লাগলেন এবং সবাইকে দোয়া পড়তে বললেন। এভাবে কিছুসময় পেরিয়ে যাবার পর, আমার এক বোন দৌড়ে এসে আব্বাকে বললো, ‘সে উঁকি দেখতে পেয়েছে আর্মিদের আর দেখা যাচ্ছে না।’ কিন্তু আমার বড় ভায়ের কিছু হলো কিনা, তাঁকে কি আর্মি নিয়ে গেল কিনা- সে চিন্তায় সবাই শংকিত ও অস্থির হয়ে রইল। এ যেন শ্বাপদসঙ্কুল অসহায় অবস্থা যেখানে কেউ ভয়ে বের হতেও সাহস করছে না।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বড়ভাই নেমে এসে দরজা খুলে দেয়ার জন্য জোরে নাড়া দিল, তখন তাকে দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তিনি নাকি বন্ধুর সাথে তাদের বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। দরজা খোলার সাথে সাথে পাশের বাসার আরিফ চাচাও ভেতরে এসে আব্বাকে জানালেন যে, আর্মিরা চলে গেছে। কিন্তু তখনও সবাই আতংকিত ও উৎকণ্ঠিত। তিনি আব্বার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যেহেতু এখন দেশের অবস্থা ভালো নয়, সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব এ ভবন ছেড়ে দ্রুত চলে যেতে হবে। সময় স্বল্প, চারদিক নিরাপত্তাহীন, গন্তব্য অনিশ্চিত –এ অবস্থায় সবাই ঠিক করলেন, আপাতত আশেপাশের কোথাও নিরাপদ স্থানে এ রাতটা পার করে পরের দিন যে যার গন্তব্যস্থলে চলে যাবেন। কিছুক্ষণ আশংকা ও অস্থিরতায় কাটানোর পর কেউ একজন এসে জানালেন যে, বন্দর হাই স্কুলের পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসী অধ্যুষিত নিমতলা গ্রামের মুরব্বী আবু সৈয়দ সওদাগর সাহেবের বাড়ির দিকে সবাইকে রওনা হতে হবে। তিনি সবাইকে অবিলম্বে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতে বলেছেন। ন্যায়বান ও সুসম্পর্ক থাকায় তাঁর দোকান থেকে এ ভবনের সবাই সদাই করতেন। বন্দর এলাকায় তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
মাগরিব নামাযের আগেই প্রত্যেক পরিবার ঝটপট যে যেভাবে সম্ভব প্রস্তুতি, সম্বল ও প্রাণটা নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে হাজি সাহেবের বাড়িতে (আশ্রয়কেন্দ্র) উপস্থিত হলো। পালিয়ে যাবার সময় শুধুমাত্র পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ স্‌হানের প্রতি সবার ভাবনা ছিল। ফিরে দেখার সময় নেই- চোখগুলো অশ্রুসিক্ত, শরীর অবসাদগ্রস্ত, মন আতংকিত কিন্তু গতি বিরামহীন। অনিবার্য পরিণতি ও অনিশ্চিত নিয়তি মেনে নিয়ে সবাই এক ভিন্ন সংগ্রামের মুখোমুখি হলো সাথে নতুন পরিচয় ও অভিজ্ঞতা : উদ্বাস্তু -আশ্রয়প্রার্থী- শরণার্থী। যেহেতু আশ্রিত পরিবারগুলোর বহর বড়, অবস্থান অনির্ধারিত এবং সম্পদ সীমিত, তাই সবার সাময়িক আশ্রয় হয়েছিল হাজি সাহেবের চার তলা ফ্লাটের ছাদে। বস্তুত সেই ছাদ পরিণত হয়ে গিয়েছিল ছোটখাটো এক শরণার্থী শিবিরে, যেখানে আগন্তুক সদস্যরা এলোমেলো, ঠাসাঠাসি অবস্থায় হয়ে গিয়েছিল পরিশ্রান্ত, বিপর্যস্ত ও ভীত সন্ত্রস্ত। সেখানে জীবনের সাথে সাথে মনস্তাত্ত্বিক সংকটও দেখা দিয়েছিল।
রাতের পরিসীমা ও গভীরতা যতই বাড়তে লাগলো, ততই রাত তার হিংস্রতা ও কদর্যতার মুখোশ খুলতে লাগল। ব্লাক আউটের কারণে সেদিন রাতের চেহারা ও আচরণে ছিল না কোন স্বাভাবিকতা, সৌন্দর্য ও প্রশান্তি। সেটা ছিল এক দানবীয় ও নারকীয় রাত। অসহায় বাঙালিরা দেখতে লাগলো বীভৎস ও ভয়াবহ রূপ নিয়ে আবির্ভূত এক অদ্ভুত ও অশুভ কালো রাতের তাণ্ডবনৃত্য ও নৃশংসতা, যার কুশীলব ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
সেই রাতে যখন অনেক শিশু মায়ের বুকে নিরাপদ আশ্রয়ে পরিপূর্ণ আহার খেয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন, আমি তখন ঘুম তো দূরের কথা – অর্ধাহারে, অপরিচিত পরিবেশে, বিপন্ন পরিস্থিতিতে কান্নারত ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে আম্মাকে ক্রমাগত জিগ্যেস করতে থাকলাম,
” আচ্ছা আম্মা, আমরা এখানে কেন? আর্মিরা কি আবার আসবে? আমাদেরকে আর্মিরা কি মেরে ফেলবে? আকাশ এত লাল কেন? এখানে চারিদিক এত শব্দ কেন? আকাশে এগুলো কিসের আগুন?”
রাতে আম্মা তখন আমাকে পানি পান করিয়ে ঘুম পাড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় ব্যস্ত এবং বারবার অভয় দিচ্ছিলেন আর দোয়া পড়তে লাগলেন। কিন্তু এক বৈরী ও অজানা আতংক আমার স্বপ্নের ভুবন ও শিশু মন একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। সবার ছোট ছিলাম বিধায় সারাক্ষণ মায়ের সান্নিধ্য থাকতাম, বিপদের সময় যেভাবে একটা প্রাণী তার বাচ্চাকে আগলে রাখে, সেরকম অবস্থা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার লড়াই।
আকাশে সার্চ লাইটের ব্যাপক আলোর বিচ্ছুরণ ও কামানের গোলার প্রচণ্ড আওয়াজ চৈত্রের উত্তপ্ত রাতের প্রখরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার ঘুমহীন চোখগুলো আকাশে তারার পরিবর্তে শুধুই দেখেতে পেয়েছিল বন্দরের দিক থেকে ছুটে আসা অজস্র আগুনের ধাবমান গোলা এবং লেলিহান শিখা ও স্ফুলিঙ্গ, বিকট শব্দে কানগুলো হয়ে গিয়েছিল প্রায় বধির, হৃদপিন্ডের অবিরাম ধড়ফড়ানিতে মনে হচ্ছিল জীবনের আলো বুঝি নিভে গেল। অন্ধকারের রাজপুত্র শয়তান ও তার সাগরেদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছাদের এক প্রান্তে আব্বা ও অন্যরা আল্লাহর সাহায্য কামনা করছিলেন এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও অনিশ্চিত পরিণতিতে নির্ঘুম আলোচনায় তাঁরা রাতের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছিলেন।
উল্লেখ্য, সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরের যুদ্ধ জাহাজগুলো থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে মূহূর্মুহূ শেলিং করেছিলো এবং হালিশহরের বাঙালি ই,পি,আর, সদস্যদের মেশিনগান দিয়ে হত্যায় লিপ্ত ছিল। তাদের সাথে বিহারী এবং রাজাকাররাও ঘুমন্ত বাঙালিদের হত্যায় মেতে উঠেছিল।
শুনেছিলাম, পরের দিন বন্দরের মহেশ খালে অনেক লাশ ভেসে এসেছিল। জানিনা, সেগুলোর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল কিনা। হয়ত সেগুলো ছিল কারো বাবা, স্বামী কিংবা ভাইয়ের লাশ। এমন গণহত্যা কি কখনও ভুলতে পারবো? এ গণহত্যার অবশ্যই বিচার হতে হবে।
* আজ ২৫ মার্চ ২০২২ তারিখ বিস্ময়করভাবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেই অবরুদ্ধ ভয়াল কালো রাতের কথা আবার মনে পড়ে গেল যেখানে আমি একজন শিশু হিসেবে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, আমাদের শত্রু ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। সে যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া এজন্য যে, ২৫ মার্চের সেই গণহত্যার রাতে আমরা জীবন বাঁচাতে পেরেছিলাম!
আরো শুকরিয়া, আমরা এক স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম।
লেখক ঃ পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, চট্টগ্রাম অঞ্চল

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার পঞ্চাশ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা