অপহরণ চক্র সক্রিয়

‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব’

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ১৩ মে, ২০২৩ at ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সুমন আলী (২৬) নামে এক যুবককে বাঘা থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছে চট্টগ্রামে। পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। এ ঘটনায় সুমনের বড় ভাই বাদী হয়ে গত রোববার (৭ মে) বাঘা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। অপহৃত সুমন বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের বাউসা ঠাকুরপাড়া গ্রামের আকাল আলীর ছেলে।

সুমনের বড় ভাই সুজন আলী আজাদীকে বলেন, উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের বাউসা ঠাকুরপাড়া গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ওয়াহিদ আলীর মাধ্যমে জনৈক আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয় সুমন আলীর। প্রায় ৩ মাস আগে ইতালিতে যাওয়ার জন্য আবদুর রহিমের সঙ্গে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। ইতালি যাওয়ার কথা বলে শনিবার (৬ মে) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সুমনকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে যায় অপহরণকারী চক্র। সুমনকে চট্টগ্রামের কোনো পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে রাখা হয়েছে ধারণা করে সুজন আলী বলেন, সেখান থেকে আমার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বাঘা থানার ওসি খায়রুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, এ বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। তাকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন থানায় খবর পাঠানো হয়েছে। পুলিশের একটি টিম ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, পাওনা আদায়ে কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে ঘটছে অপহরণ। নতুন এক শ্রেণীর অপহরণকারী চক্র গজিয়ে উঠেছে যারা আর্থিক লোভে অপহরণ করছে। বিশেষ করে অপহৃতদের মধ্যে শিশু সন্তানই বেশি। পরবর্তীতে মুক্তিপণ আদায় না করেই ধরা পড়ার ভয়ে এসব শিশুকে খুন করতেও দ্বিধা করছে না সদ্য গজিয়ে ওঠা অপহরণকারীরা। বর্তমান সময়ের অপহরণকারীদের নিয়ে তাই শঙ্কিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগণও। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে পেশাদার অপহরণকারীরা দেখা যেত অর্থের লোভেই অপহরণ করতো এবং টাকা আদায়ের প্রয়োজনেই তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতো। টাকা পেলে ফিরিয়ে দিত অপহৃতকে। বিভিন্ন থানার ডায়েরি সূত্রে জানা গেছে গত পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় শতাধিক নিখোঁজ হয়েছে। এদের অনেকের লাশ পাওয়া গেছে ঘটনার কয়েক দিন পর; তাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘ক্রাইম ইন বাংলাদেশ: অ্যাবডাকশন / কিডন্যাপিং : অ্যান ওভারভিউ ফ্রম বিপিও’ শিরোনামের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দেশে ঘটে যাওয়া অপহরণের ঘটনার মধ্যে রাজধানী ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান। পরিসংখ্যান মতে ঢাকায় অপহরণের ঘটনা ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে ৩২০টি অপহরণের ঘটনা ঘটছে। অপহরণের ঘটনায় করা মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করারও তাগিদ দেয় সংস্থাটি।

চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় সাম্প্রতিক অপহরণের ঘটনাগুলোর অধিকাংশের মধ্যে সহজ শিকার বানানো হয়েছে শিশুদের। নগরীর চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরা এলাকায় মো. শফিউল ইসলাম রহিম নামে এগারো বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণের পর পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের চারদিন পর গত ৩ মে ওই শিশুর লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন চান্দগাঁও থানার ওসি খাইরুল ইসলাম। তাকে অপহরণের পর এক ব্যক্তি তার বাবাকে ফোন করে ছেলেকে ফিরে পেতে হলে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অপহরণকারী আজম খানকে শিশু রহিম চিনতে পেরেছিল। এ কারণে নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে পিটিয়ে রহিমকে হত্যা করা হয়। এরপর একটি গর্ত করে রহিমের লাশ মাটিচাপা দেয় ঘাতক।

গত ১ মে চট্টগ্রামে অপহৃত এক যুবককে উদ্ধার ও মুক্তিপণ আদায়চক্রের মূলহোতাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব, চট্টগ্রাম। পরে ভুজপুর উপজেলার রহমতপুর এলাকা থেকে অপহৃত যুবককে উদ্ধার করা হয় বলে জানান র‌্যাব৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নূরুল আবছার। গত ২৮ এপ্রিল তাকে অপহরণ করে ভুজপুর থানাধীন ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি অজ্ঞাত এলাকায় নিয়ে যায় এবং শারীরিক নির্যাতন করে। পরে অপহরণকারীরা ভিকটিমের পরিবারের কাছে ১ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

গত ৩১ মার্চ অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে পাঁচজনকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নগরীর খুলশী থানাধীন ওয়াসা মোড় এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করা হয়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, আটক ব্যক্তিরা আব্দুল মতিন নামে একজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য মাইক্রোবাস নিয়ে ওয়াসা মোড় এলাকায় অবস্থান করছিল। পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেন। পাশাপাশি অপহরণের শিকার আব্দুল মতিনকে উদ্ধার করা হয়।

গত ২৮ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী থানার মুরগির ফার্ম আলমতারা পুকুরপাড় এলাকার একটি ডোবা থেকে ১০ বছরের শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীর লাশ উদ্ধার করে পিবিআই। গত ২১ মার্চ আয়নীকে অপহরণ করা হয়েছিল।

নগরীর ইপিজেড থানার কলসি দিঘী এলাকা থেকে গত ২৫ জানুয়ারি দুপুরে অপহৃত আড়াই বছরের শিশু হৃদয়কে ফেনী থেকে উদ্ধার করা হয় এবং জড়িত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে দেড় বছরের এক শিশুকে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে প্রতিবেশী জুয়েল মিয়াকে (২৪) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বায়েজিদ বোস্তামী আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে অপহরণকারীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। র‌্যাবএর মুখপাত্র মো. নুরুল আবছার জানান, প্রতিবেশী জুয়েল মিয়া তাকে অপহরণ করে শিশুটির বাবা পিয়ার মোহাম্মদকে ফোন করে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

গত ৮ জানুয়ারি ফটিকছড়ি উপজেলা থেকে এক কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনের মতে, অনলাইন নির্ভরতার কারণে অনেকেই নিজের মস্তিষ্কজাত বুদ্ধি বিবেচনা ও নৈতিকতাকে ভুলতে বসেছে। অনেকে অপরাধ সংঘটনের জন্য শিশুদের বেছে নেয়, আবার হীনইচ্ছা চরিতার্থে শিশুদের টার্গেট করা হয়। পাশাপাশি পরিবারের বড় সদস্যদেরও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে অথবা আর্থিক লোভের আশায় অপহরণ করছে। অপহরণ করলেও এদের মুক্তিপণের চাহিদা থাকে অনেক কম। সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬