অপরাধ বন্ধ করতে চাই সামাজিক মজবুত বন্ধন

| সোমবার , ২১ মার্চ, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

আমাদের বাংলাদেশ এক বৈচিত্র্যময় দেশ। পুরো ভূখণ্ড জুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি – সবদিক থেকেই এই বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতির জন্য বাংলাদেশ এক মডেল। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই দেশ এক আন্তরিক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হলো একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি দয়া, মায়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা। মানুষ একে অপরের সুখে সুখী হবে এবং একে অপরের দুঃখে দুঃখী হবে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি এমন সহানুভূতিশীল হতে হবে। কেউ কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। এক সমপ্রদায় অন্য সমপ্রদায়ের ওপর আভিজাত্য প্রকাশ করবে না। সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সৌহার্দ্য ভাব স্থাপন করতে হবে। সমাজে মানুষে মানুষে যে সংঘাত-সহিংসতা, কলহ-বিগ্রহ, হানাহানি, খুনোখুনি, লুটতরাজ, হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা চলছে, এসব অনাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
অনেকে মনে করেন, পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে আলগা হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। মা-বাবার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন সন্তানেরা। এক পরিবারে থেকেও মা-বাবা ও সন্তানেরা দিন কাটাচ্ছেন যে যাঁর মতো করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন আর আগের মতো দৃঢ় নয়, হয়ে পড়েছে বড়ই ঠুনকো। পত্রিকান্তরে এ বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তাতে তরুণদের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। তরুণেরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিষয়েই তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি। মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বাড়ছে। মা-বাবা দুজনেই আয়-রোজগারে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই কি দূরত্ব কমছে না, এ প্রশ্নটাও এসেছে জরিপে। সব মিলিয়ে মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে তরুণেরা আগের মতোই বেজায় উদ্বিগ্ন।
পরিবার নিয়ে গুণগত জরিপেও দেখা গেছে একই চিত্র। গুণগত জরিপে ২০ জনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন বিশেষজ্ঞ আর সাতজন পুরুষ ও সাতজন নারী। তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, দেশের তরুণেরা কি আগের তুলনায় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন, তাঁরা কি অনলাইনে খুব বেশি অনুৎপাদনশীল সময় কাটাচ্ছেন এবং ক্রমশ মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তরুণেরা এ বিষয়ে বলছেন, সন্তানেরা মা-বাবার কাছ থেকে মনোযোগ ও সময় পাচ্ছেন না। বিশেষ করে মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবী হলে এই সংকট আরও তীব্র হয়। বাবা-মায়েরাও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে (ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতি) আসক্ত হয়ে পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানকে টেলিভিশনে কার্টুন সিরিজ দেখতে বসিয়ে বাবা-মায়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেন। আবার জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের একাংশ বলছেন, বাবা-মায়েরা কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের ওপর শৃঙ্খলার বিষয়টি চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত কঠোরতা দেখাচ্ছেন। তাঁরা সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছেন পড়াশোনার বিষয়েও। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে মা-বাবার আগ্রহ কম। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সন্তানদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে, তাঁরা আটকে পড়ছেন মাদক ও হতাশার ফাঁদে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-বাবা ও সন্তানদের মধ্যকার এই ক্রমবর্ধমান দূরত্ব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে মা-বাবাকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদলে সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মা-বাবার দেখাদেখি সন্তানেরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন আসছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিও সন্তানদের শেখাতে হবে মা-বাবাকেই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিত্ত-বৈভবের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন কোথাও কোথাও দুর্বল বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই বন্ধন সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে অপরাধ অনেক কমে যাবে। তাঁরা বলেন, সামাজিক অপরাধ দমনে সমাজ, সমপ্রদায় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে কার কী ভূমিকা, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
সমাজ অপরাধমুক্ত করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, শুধু শাস্তি দিয়ে অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। অপরাধ বন্ধ করতে শাস্তির পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধনামিবিয়ার জাতীয় দিবস, বিশ্ব অরণ্য সংরক্ষণ দিবস এবং বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস