বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের এসব নাগরিক উখিয়া–কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অর্থ লেনদেন ও ব্যবসা–বাণিজ্য করছে। অনেকেই অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছে। প্রশাসনের অগোচরে ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের কমিটি করছে রোহিঙ্গারা। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। রাতে ক্যাম্পে কি ঘটছে তার খবর পাচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
গত ১১ জুন প্রকাশিত দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, উখিয়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে তিন রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় আহত হয়েছেন আরও সাত রোহিঙ্গা। গত সোমবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবাল। নিহতরা হলেন মো. ইলিয়াছ, মো. ইছহাক ও ফিরোজ খাঁন। এপিবিএনের অধিনায়ক মো. ইকবাল জানান, উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে শতাধিক অজ্ঞাত রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। এ সময় পাহারারত রোহিঙ্গা ও এপিবিএন সদস্যরা বাধা দিলে তাদের উপর পাল্টা হামলা করে। এক পর্যায়ে তারা গুলি করে এবং কুপিয়ে তিন রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্যাম্পে সক্রিয় মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন জানান, খবর পেয়ে নিহত তিন রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত রোববার দিবাগত রাতে র্যাব অভিযান চালিয়ে ওই ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ নেতা মৌলভী আকিজসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের গ্রেপ্তারের পর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কারা, কেন রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে তার খোঁজ নেয়া হচ্ছে। সেখানে কর্মরত এনজিওগুলোর কার্যক্রম মনিটর করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার রক্ষা ও বাংলাদেশের পরিবেশগত দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন জরুরি। তাঁরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে যে মানবিকতা ও বদান্যতা দেখিয়েছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ। বিশ্বদরবারে সব মহলে প্রশংসিত হয়ে তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে দফায় দফায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্রয় দেন। আয়তনে ক্ষুদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কঙবাজারে আশ্রয় দেন প্রধানমন্ত্রী। এর পর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সহায়তায় তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকার নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু তাদের প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ক্রমশই রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, মাদক দ্রব্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই আছে। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে এবং মিয়ানমারের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অথচ এখন তাদের ফিরে যাওয়ার দরকার। যখন প্রয়োজন হয়েছিল তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে তাদের আজীবন ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবী নিজেই এক বিরাট সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মুহূর্ত পাড়ি দিচ্ছে এই মুহূর্তে। বছর বছর রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সংখ্যাও। ফলে যত বছর পার হবে তত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যা বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেকবার উঠেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু আসেনি।’
বলা অত্যাবশ্যক যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের জন্যও হুমকি। রোহিঙ্গাদের যদি দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া না হয় এ সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ ঝুঁকিতে। যেভাবেই হোক সমাধান জরুরি।