এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪/১৫ জন খুন হচ্ছেন। তবে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খণ্ডিত লাশ। এতে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকাণ্ড।
কেন এই অস্থিরতা? এর উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতি জোর দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এঁরা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
পরিবার হলো মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এখন পরিবারের মধ্যেও নিরাপত্তা খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। সামাজিক অবস্থার অপপ্রভাবে পরিবারের সদস্যদের একের প্রতি অপরের মমত্ববোধ হ্রাস পাওয়া এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে আপনজনের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নৈতিক মূল্যবোধের অবস্থায়, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লিপ্সা, মাদকাসক্তি ও অবৈধ দৈহিক সম্পর্কের কারণে। হত্যাকাণ্ড ঘটছে সামাজিক অবস্থা কত ভেঙে পড়লে নিজের আদরের সন্তানের হাতে জন্মদাতা পিতা–মাতার প্রাণহানি, যৌতুক কিংবা ক্ষুদ্র বিষয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রীর খুন হওয়া, বড় আদরের ছোট ভাইকে নিজ হাতে জবাই এসব ঘটে চলেছে। মানুষ ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।
অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. জিয়া রহমান এ বিষয়ে বলেন, সামাজিক কারণে আমাদের দেশে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা নতুন কিছু নয়। বর্তমানে গণমাধ্যমের কল্যাণে তা সবাই হয়তো প্রত্যক্ষ করতে পারছে। শিশুহত্যার মতো যে ধরনের ঘটনা ঘটছে, তা সামাজিক কারণেই ঘটছে। যার বেশির ভাগ শিকার নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারের শিশু। তিনি বলেন, আমাদের সমাজব্যবস্থার যে কাঠামো তাতে দেখা যায় যে, অপরাধীরা সাধারণত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশেই অপরাধ কমানোর জন্য সামাজিক অনুশাসনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা নেই। শিক্ষার অভাবও এর জন্য দায়ী। তবে তিনি আশাবাদী যে এ বিষয়ে জনমত তৈরি হবে। শিশুহত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও কমে আসবে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও মাদকের কারণে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। সহিংসতার বিকাশ ঘটছে। দেখা গেছে, যেসব নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে সেখানে খুনিরা হয়তো কখনও খুনি ছিল না। এ ক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব ও মাদকের বিস্তারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের জিঘাংসা ও মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। এর ফলে ব্যক্তি খুনের মতো জঘন্যতম কাজ করতে পিছপা হয় না। কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিকতা কখনও কাম্য হতে পারে না। এ বিষয়ে সরকারসহ আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এ নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সর্বোপরি বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। সে আত্মবিশ্বাসী হয় না। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুরাই নৃশংসতার শিকার হয় বেশি। কারণ শিশুরা দুর্বল। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিরোধও করতে পারে না।