চট্টগ্রামে নারী অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটনেও পিছিয়ে নেই নারীরা। গত এক বছরে চট্টগ্রামে অপরাধ পর্যালোচনা এবং গ্রেফতারকৃত অপরাধীদের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ সত্য ধরা পড়ে। একদা ঘর-সংসার সামলাতো যে নারী, সে-ই এখন সংসারে সচ্ছলতা আনতে হয়ে উঠছে অপরাধপ্রবণ। অতীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্ততা ছিল খুবই কম। এখন দিন দিন তাদের সম্পৃক্ততা বেড়েই চলেছে। দারিদ্রতা, অপরাধী হিসেবে নারীর প্রতি সন্দেহ তৈরি না হওয়া, তার ভালো ইমেজের অধিকারী হওয়া এবং অপরাধে জড়াতে পারে না এমন বিশ্বাসের সুযোগে ক্রমেই নারী অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্যমতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতে নারীর সংখ্যা নামমাত্র। তা ছাড়া নারীদের অপরাধ জগতে প্রবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা নেই। কোনো টিমে একজন নারী থাকলে সাধারণ মানুষ যেমন সন্দেহ করে না, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল দলও রাস্তায় তল্লাশিকালে তেমন হেনস্থা করে না। এ ছাড়া নারী অপরাধীদের কোনো তালিকা নেই র্যাব পুলিশের কাছে। এসব দিক বিবেচনা করে অপরাধ জগতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। গত এক বছরে গ্রেফতারকৃত ডাকাত, চোর, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, টানা পার্টি, জাল টাকা সরবরাহকারী, প্রতারক, অস্ত্র বাহক, মাদক ব্যবসায়ী এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও নারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে নগর পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক আজাদীকে বলেন, পুরুষ অপরাধীর ক্ষেত্রে আমরা যতোটা এগ্রেসিভ হতে পারি, অপরাধী নারী হলে আমরা তা পারি না। তাছাড়া ধরেন, এক ব্যবসায়ীকে কিডন্যাপ করতে চায়। তাকে কোনো পুরুষ ডাকলে সে নাও আসতে পারে, কিন্তু নারী হলে তাকে নিয়ে আসাটা সহজ হয়। এসব কারণে অপরাধের ক্ষেত্রে নারীর সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে।
চট্টগ্রাম নগরীসহ সারা দেশে যেসব মৌসুমি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার প্রতিটিতেই পুরুষের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে নারীরা। টাকার বিনিময়ে নবজাতককে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে নানিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন পাঁচলাইশ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- শিশুটির নানি রাবেয়া খাতুন (৩৫), মো. হারুন (৫৫) এবং মনোয়ারা বেগম (৩৭)।
কখনও মিনু, কখনও সুমি, কখনো ফাতেমা আবার কখনও রোমানা নামে পরিচিত তিনি। এসব নামের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে একাধিক নামে একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিক সনদপত্র। তিনজন বৈধ স্বামীর পরিচয় পাওয়া গেলেও রয়েছে আরও অনেক স্বামী। একাধিক প্রতিষ্ঠানে ছদ্মনাম এবং ভিন্ন ভিন্ন নামের সার্টিফিকেট ব্যবহার করে একাধিক চাকরিও করেছেন তিনি নির্বিঘ্নে। বিয়ের নামে বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ-সম্পদ লুট, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে নানামুখী প্রতারণা-জালিয়াতি ও নিরীহ লোকদের হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে এই প্রতারক (৩৬) নারীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন লালদীঘির উত্তর পাড় থেকে ছিনতাই চক্রের তিন নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন এ প্রসঙ্গে জানান, ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে রিফাত শামীম জেনারেল হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে লালদীঘির উত্তর পাড়ে ওরিয়েন্ট টাওয়ারের নিচে গ্রেপ্তারকৃতরা তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চারপাশে ঘিরে ফেলে। গ্রেপ্তারকৃতরা তাকে মারধরের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে গলায় থাকা একটি স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, এই নারীরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। ইতিপূর্বেও রাস্তা পারাপারে একই স্থানে কৌশলে মহিলাদের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস, স্বর্ণের চেইন, মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। গ্রেপ্তারকৃতরা টেরিবাজার, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অপরাধ সংঘটন করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পাপিয়া বেগমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় তিনটি ও রুমা আকতারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা রয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর নগরীতে চোরাই মালামাল সহ চোর চক্রের ৩ নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে বায়েজিদ থানা পুলিশ।
১৫ আগস্ট চুরির দায়ে ডবলমুরিং থানায় মা-মেয়ে গ্রেপ্তার হন। ভিক্ষা দিতে বাড়ির মানুষ যখন ভেতরে যান তখনই ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যান তারা! এমন অভিনব পন্থায় চুরি করতে গিয়ে মা-মেয়ে পুতুল বেগম (৪০) এবং শারমিন (২০) মৌলভীপাড়ার কামার গলি থেকে ধরা পড়েন। ৪ আগস্ট ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদ এলাকা থেকে কাজের বুয়া সেজে ইয়াবা বিক্রির সময় মাফিয়া বেগম (৫০) এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ আগস্ট নগরীর একটি বাসায় বিভিন্ন বয়সী তরুণীদের আটকে রেখে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি করানোর অভিযোগে নারীসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২ আগস্ট সহানুভূতিকে পুঁজি করে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাবেয়া চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। ১ আগস্ট বোয়ালখালী উপজেলা সদরের মীরপাড়া এলাকায় একটি বাসায় এক গৃহবধূকে দল বেঁধে ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে এক নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।