আমরা কোথায় যাচ্ছি? আলোর দিকে! না অন্ধকারের অতল গহ্বরের দিকে! প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, সোশ্যাল ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত সামাজিক অবক্ষয় তথা অপরাধ প্রবণতার ধরন দেখে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সভ্যতার অগ্রগতির ফলে আমরা যতটা আলোকিত হচ্ছি ঠিক ততটাই আলো হারাচ্ছি। এখন থেকে বিশ/ ত্রিশ কিংবা তারও আগে সমাজ যে অপরাধমুক্ত ছিল, পূত ছিল তা কিন্তু নয়। তখনও অপরাধ ছিল। নারী ধর্ষণ হতো। বলাৎকার হতো। বাল্যবিবাহ ছিল। যৌতুক প্রথা ছিল। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ছিল। চুরি হতো। আত্মহত্যা ছিল। আত্মহত্যায় প্ররোচণা ছিল। স্বামী বা স্বামীর পরিবার কর্তৃক নির্যাতন ছিল। নির্যাতন করে মেরে ফেলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছিল। আজকের সমাজেও সেই অপরাধপ্রবণতাগুলো বহাল তবিয়তেই বিদ্যমান। সে সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের নতুন নতুন অনুষঙ্গ।
অপকর্মের নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার ফলে আগেকার অপরাধ আর বর্তমান অপরাধের পাল্টেছে ধরন, বেড়েছে বিস্তৃতি ও নিয়েছে ভয়াবহ রূপ। অপরাধগুলোর ডালাপালা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে তা রূপ নিয়েছে চরম আগ্রাসীরূপে। বর্তমান সমাজে চুরি-ডাকাতি খুব একটা নেই বললেই চলে, তার জায়গায় এসেছে সরাসরি সন্ত্রাস। এখন স্থান কাল ভেদে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে ছিনতাই হয়, জায়গা-জমি দখল হয়। চাঁদাবাজি হয়। পাহাড় কাটা হয়। বনভূমি নিধন হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে হাইজ্যাক হয়। সামান্য কারণে ভেঙে যায় পরিবার, পরিবারের সন্তানেরা বাপ-মা থাকতেও হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন। ধর্ষকেরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। এখন মানুষ পলকে নরপশু হয়ে যায়। মাসুম শিশুকন্যা থেকে কিশোরী মেয়েরাও আজকাল ধর্ষিত হচ্ছে। বেশিরভাগ শিশুই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় কর্তৃক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়ে মেয়েরা আপন গৃহকোণেও নিরাপদ নয়। কারও না কারও ধারলো থাবা উদ্যত হয়ে আছে তাদের দিকে। এক শ্রেণির মানুষ নামের নরপশু লকলকে জিভ দিয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়ে মানুষের দিকে। ধর্ষণ করে কিংবা ধর্ষণ ও হত্যা করে কখনো টাকার জোরে, কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায় অপরাধী। এভাবেই ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে ন্যায্যতা। কাঁদছে বিচারের বাণী নিভৃতে। এ কারণে অপরাধীরা নিবৃত্ত হওয়ার বদলে দ্বিগুণ উৎসাহে প্রবৃত্ত হচ্ছে অপরাধকর্মে। আইনের সঠিক প্রয়োগ কিংবা আইনের রক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণের অভাবে অনেক পরিবারই ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিলম্বিত বিচারের কারণে ভুক্তভোগী পরিবার মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। যে ঘরের মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে তারাই শুধু বোঝে অপমানের জ্বালা আর ক্ষতের গভীরতা।
ধারণা করা হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের দিক দিয়ে আমরা এখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে চলে এসেছি। যে শিশু-কিশোরদেরদের হাতে বই-খাতা-পেন্সিল থাকার কথা সেই হাতে যদি দেখা যায় ধারালু চাকু কিংবা পিস্তল তখন সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন আসে আমরা আলো নয়, অন্ধকারের দিকে এগুচ্ছি। আমাদের ভালো অর্জনগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে। অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো এখন আমাদের নাবালক কিশোর পুত্রকেও জড়িয়ে ফেলছে। হালের কিশোর গ্যাং তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারা এই কিশোর গ্যাং? তাদের অপরাধের স্বরূপ ও প্রকৃতি কি? বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় এই কিশোর গ্যাং সদস্যদের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। মূলত যে সব পরিবারে তাদের কিশোর বয়সের ছেলেদের সস্নেহে নজরদারি দুর্বল কিংবা একেবারেই নেই তারাই জড়িয়ে পড়ছে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এ ছাড়া অভিভাবকহীন, ভবঘুরে, বস্তিএলাকার কিশোররাও এতে সম্পৃক্ত হচ্ছে খুব সহজভাবে। অর্থের মোহ তো আছেই, আছে চরম কৌতুহল। এছাড়া কিশোর মানেই দূরন্ত দূর্বার। বেপরোয়াপ্রাণ এসব কিশোররা মুরব্বিরা যা নিষেধ করে তাই করতে যেন অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়। এছাড়া তাদের এই অপকর্মে প্রলুব্ধকরণে বড় ভূমিকা রাখছে বিদেশী সংস্কৃতি, উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল, ইন্টারনেট আসক্তি ও তাদের উপযোগী নয় এমন কিছু ছবি ও ভিডিও। বৈশ্বিক মহামারির কারণে দীর্ঘকাল স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণেও অনেক কিশোর বিপথগামী হয়েছে।
ঢাকা,চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোতে এই কিশোর গ্যাং এর তৎপরতা লক্ষণীয়। মাদকপাচার, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এমনকি খুনের মতো জঘন্য কাজেও তারা অংশ নিচ্ছে বা তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সহজ সরল কিশোর তাদের খারাপ বন্ধু বা সহপাঠীদের প্ররোচনায় কিশোর গ্যাং-এ জড়িত হচ্ছে। জড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের অনেকই জানেই না তারা কোন চোরাবালিতে পা রাখতে চলেছে। এই জগৎ এমন এক জগৎ যাতে যে একবার পা দিয়েছে সেদিন থেকে হারিয়ে গেছে তার সোনালি ভবিষ্যৎ। অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়া যতটা সহজ তা থেকে বেড়িয়ে আসা ততটাই কঠিন। এ কারণে যে একবার এই পিচ্ছিল পথে পা দিয়েছে সেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে একমাত্র অভাবিত মৃত্যুই হয়ে দাঁড়ায় তাদের নিয়তি।
এক সময় পাড়ায় মহল্লায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা। কিংবা দলের নাম ভাঙিয়ে এলাকার বখাটে ছেলেরা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এখন যে কিশোর গ্যাং দোর্দণ্ড প্রতাপে পাড়ায় মহল্লায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের অপরাধকর্ম তাদের মস্তিষ্কজাত নয়। এই কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্য কুশিলব কোনো না কোনো বড় ভাই। আর এই বড় ভাইয়েরা বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের স্হানীয় দাপুটে নেতা বা কর্মী। স্হানভেদে বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতাও এই কিশোর গ্যাং-এর আশ্রয় ও প্রশয়দাতা। কোনো কোনো এলাকায় পেশাদার মাস্তানরাও এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এসব নেতারা এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে কোমলমতি কিশোরদের ব্যবহার করে। ফলে সংগঠিত হচ্ছে নানা অপকর্ম।
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত। এই শিশুদের মধ্য থেকে আগামীতে বেরিয়ে আসার কথা দেশ সেরা মানুষগুলো। যাঁরা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা, সামাজিক ন্যায় বিচার, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে দেশ পরিচালনায় নিজেদের মেধা ও মননের সর্বোত্তম ব্যবহারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় বর্তমানে আমাদের শিশুকিশোররা যেভাবে বেড়ে উড়ছে, বিপথে পরিচালিত হচ্ছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে সৎ, দক্ষ ও নীতিবান মানুষ পাওয়া খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। এতে একদিকে যেমন সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে দেশের কাঙ্ক্িষত উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তাই আমাদের এখনই সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে কিশোর গ্যাং এর যে বাড় বেড়েছে তার আমূল উৎপাটনে।
কিভাবে সম্ভব এই আমূল উৎপাটন? মনে রাখতে হবে অপরাধপ্রবণতার শুরু হয় সঙ্গ দোষ থেকে। এই সঙ্গদোষ থেকে নিবৃত্ত বা দূরে রাখতে পারে একমাত্র পরিবার। পরিবার যদি শিশুদের বেড়ে উঠার সময় নিবিড় পরিচর্যা ও নজরদারি না করে তাহলে সে পরিবারের সন্তানেরা উচ্ছন্নে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা আমাদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিগুলো সন্ধ্যা নামার আগেভাগেই নিজ নিজ খোঁয়াড়ে ঢুকল কি না তার যথাযথ নজর রাখি। কোথাও যাওয়ার সময় বাসা-বাড়িতে ঠিকমতো তালাবদ্ধ করা হলো কিনা বার বার তালা টেনে দেখি। কিন্তু যে শিশুটি আপনার, আমার, দেশের ভবিষ্যত সে সন্ধ্যার আগে বাসায় বা বাড়িতে ফিরল কিনা ক’জনই বা খবর রাখি। রাখি না। সে কোথায় যায়, কার সাথে আড্ডা মারে, কোথায় আড্ডা মারে, কেন বাসায় দেরি করে ফিরে খুব একটা জিজ্ঞেস করি না।এই একটু একটু না করা থেকে মা-বাবা আর সন্তানের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দেখা যায় সেই দূরত্বের সুযোগে পরিবারের আদরের সন্তানটি বিপথে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, কিশোর গ্যাং এর উৎপত্তি ও বিকাশের পেছনে অভিভাবকদের দুর্বল ভূমিকা বিশেষভাবে দায়ী। পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা, সুশৃঙ্খল জীবনাচারের গাইড লাইন না পাওয়ার কারণে কিশোররা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থায় জিপিএ চর্চা যতটা গুরুত্ব পায় নৈতিক শিক্ষার পাঠ ততটাই অবহেলিত থেকে যায়। তৃতীয়ত বইপড়া, বিদ্যালয়কেন্দ্রিক খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা ছেলেমেয়েদের বিপথগামীতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত। এখন মাঠই নেই। ফলে এসব সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বিপরীতে শিশুকিশোর সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকছে টার্চ মোবাইলে।
কিশোর গ্যাং এর আমূল উৎপাটনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজকর্মী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সর্বোপরি সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ অপরাধপ্রবণতার শেকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই কারও একার পক্ষে এই সমাজবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড রোধ করা সম্ভব নয়। পরিবার যদি তার নাড়ির ধনকে আগলে না রাখে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা স্থানীয় মাস্তানরা যদি আশ্রয়-প্রশয় ও আশকরা দেয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি সুশিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে দায়িত্বশীল ভূমিকা না রাখে সর্বোপরি আইন শৃঙ্খল বাহিনী যদি কিশোর গ্যাং এর দমনে পক্ষপাতহীন কঠোর ভূমিকা না রাখে তাহলে কিশোর গ্যাং কেন কোনো অপরাধপ্রবতাই রোধ করা সম্ভব হবে না। তাই আমরা আশা করব সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে এখনই এই মুহূর্তেই সক্রিয় হবেন। দেশকে বাঁচান। মনে রাখতে হবে অস্থির প্রজন্ম কখনো সুস্থির সমাজ উপহার দিতে পারে না। বহু রক্ত আর কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটাকে যদি সুখি, সুন্দর ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে না পারি তাহলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না। করতে পারে না।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক