করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অপমান হওয়া থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত হয়েছেন বহু এশীয়-মার্কিনি। এই অপরাধ রুখতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন পাস করেছে নতুন আইন। কিন্তু কি কারণে বাড়ছে এই এশিয়া-বিদ্বেষ?
একবছর আগে করোনাভাইরাস মহামারীর শুরু থেকে এশীয়-মার্কিনিদের ওপর সহিংসতার গুটিকয়েক উদাহরণ দিয়ে বিদ্বেষের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে বিবিসি। এতে দেখা গেছে, কয়েকটি ঘটনায় এশীয়-মার্কিনিরা খুন এবং জখম হয়েছে। একটি ঘটনায় একজন বৃদ্ধ থাই মার্কিন অভিবাসীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তিনি মারা যান। ছুরি দিয়ে মুখমন্ডলে আঘাত করা হয় আরেক ফিলিপাইন-আমেরিকানের। চীনা এক নারীকে চড় মেরে তার শরীর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এশীয় স্পা গুলোতে একই রাতে একাধিক গুলির ঘটনায় মারা যায় ৮ জন। এছাড়াও, সমপ্রতি কয়েক মাসে এশীয়-মার্কিনিদেরকে থুতু দেওয়া থেকে শুরু করে মৌখিক এবং শারীরিকভাবে হেনস্থা কিংবা অপমান করার হাজার হাজার ঘটনা ঘটার খবর সামনে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে যারা সোচ্চার তারা বলছেন, এসবই হেট ক্রাইম এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোভিড-১৯ ছড়ানোর জন্য এশীয়দেরকে যে দোষের ভাগী করা হয়েছে তা থেকে এশীয়-মার্কিনিরা বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলেছিলেন। তারপরই দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড সংক্রমণ যত বেড়েছে, ততই এশীয়-মার্কিনিরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
হচ্ছে কী যুক্তরাষ্ট্রে ? করোনাভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ার শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এশীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। ২০২০ সালের বিদ্বেষমূলক অপরাধের কেন্দ্রীয় তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে গতবছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এশীয়-আমেরিকানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেড়ে যাওয়াকে ‘উদ্বেগজনক’ বলা হয়েছিল। যেহেতু কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা লম্বা সময় ধরে ঘটনাগুলোর যথাযথ হিসাব রাখে না এবং এলাকাভেদে ঘটনারও বেশ-কম হয়ে থাকে, তাই এ ধরনের অপরাধের সঠিক সংখ্যা জানা মুশকিল। এশীয় আমেরিকান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সংস্থা ‘স্টপ এএপিআই হেইট’ বলছে, গতবছর ২,৮০০-রও বেশি বিদ্বেষমূলক অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে তারা। মহামারীর শুরুতেই অনলাইনে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে এই সংস্থা।
নিউ ইয়র্ক এর বিদ্বেষমূলক অপরাধ বিষয়ক টাস্ক ফোর্স বলছে, ২০২০ সালে ২৭টি ঘটনার তদন্ত তারা করেছে, যা এর আগের বছরের চেয়ে ৯ গুণ বেশি।
ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড পুলিশ জানায়, শহরের চায়না টাউনে নতুন পাহারা বসানোর পাশাপাশি কমান্ড পোস্ট বসিয়েছে তারা। বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের প্রায় ৭০ শতাংশই মৌখিক হয়রানি। তাছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধের বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজও ভাইরাল হয়েছে। জনপ্রিয় তারকারা এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার অবস্থা : প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি এশীয়-আমেরিকানের বাস ক্যালিফোর্নিয়ায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনও রাজ্যে সর্বোচ্চ। রাজ্যটির ১৫ শতাংশই এশীয়-আমেরিকান। এ রাজ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এশীয়দের প্রতি বিদ্বেষমূলক অপরাধও বেশি দেখা গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। মহামারীর প্রকোপে অচল হয়েছে রাজ্যের অর্থনীতি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত রাজ্যের ৩৪টি অঞ্চল থেকে ৮শ’র’ও বেশি হেট ক্রাইমের অভিযোগ এসেছে। এসব ঘটনাই করোনাভাইরাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানিয়েছে এশিয়ান প্যাসিফিক পলিসি প্ল্যানিং কাউন্সিল। ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব হেট অ্যান্ড এক্সট্রিমিজম’ এর তথ্যানুযায়ী, অরেঞ্জ কাউন্টিতে এশিয়া-বিদ্বেষ বেড়ে গেছে ১,২০০ শতাংশ পর্যন্ত। পাশেই লস অ্যাঞ্জেলেসে এশীয়দের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম ১১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে সিবিএস নিউজ।
প্রতিক্রিয়া কী ? এশীয়-আমেরিকানদের নিয়ে যারা সোচ্চার তারা বলছেন, সমপ্রতি এশিয়া-বিরোধী সেন্টিমেন্ট বেড়ে যাওয়ায় সহিংসতা বেড়ে গেছে।
অনেকে এই সহিংসতা বাড়ার জন্য সরাসরি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করে বলছেন, করোনাভাইরাসকে তার ‘চীনা ভাইরাস’ কিংবা ‘কুং-ফ্লু’তকমা দেওয়ার কারণেই এশিয়া-বিদ্বেষ বেড়েছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম সপ্তাহেই দাপ্তরিকভাবে এসব শব্দ ব্যবহার করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এছাড়াও, কংগ্রেসের দুই চেম্বারেই ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এশিয়া-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং পদক্ষেপ নেওয়ারও চেষ্টা চলেছে, যার অংশ হিসেবে গত ২০ মে বাইডেন কোভিড-১৯ বিদ্বেষমূলক অপরাধ রুখতে নতুন বিলে সই করে তা আইনে পরিণত করেন। ‘কোভিড-১৯ হেট ক্রাইম অ্যাক্ট’ নামক এই আইনের আওতায় এশীয়-আমেরিকান ও প্যাসিফিক আইল্যান্ডারদের (এএপিআই) বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং হেট ক্রাইমের রিভিউ দ্রুত করার কথা বলা হয়েছে। সেজন্য বিচারবিভাগ রাজ্য সরকারকে যথপোযুক্ত অর্থ সাহায্য দেবে।
তাছাড়া, কীভাবে হেট ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়তে হবে সে নীতিও তারা ঠিক করে দেবে। হেট ক্রাইম নিয়ে মানুষের চেতনা বাড়াতে প্রচার চালানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে বিলটি দু’দিন আগেই ৩৬৪-৬২ ভোটে পাস হয়েছে। এর আগে গত এপ্রিলে সেনেটে বিলটি মতৈক্যের ভিত্তিতে পাস হয়েছিল।
‘আমাদেরকে একটি জাতি হিসেবে একত্রিত হতে হবে’ হোয়াইট হাউজে গত বৃহস্পতিবার বিলটি সই করার সময় বলেন বাইডেন। তিনি আরও বলেন, বিদ্বেষমূলক অপরাধ একটি ‘নোংরা বিষয় যা জাতিকে বহুদিন ধরে বিষাক্ত করে রেখেছে।’ হেট ক্রাইমের শিকার ব্যক্তিদের সংস্থানসহ এই অপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যালিফোর্নিয়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪ লাখ ডলার। মাঠ পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে আরও পদক্ষেপ।
কেন হচ্ছে এমনটা ? জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এশীয়-আমেরিকান হওয়ার পরও তাদের সমপ্রদায়ের গল্পগুলো তুলে ধরে না স্থানীয় গণমাধ্যম। কিংবা তাদের বিশেষ চাহিদাগুলোর দিকে মনোযোগী হন না রাজনীতিবিদরা। সেকারণেই গণহারে বেড়ে যায় বিদ্বেষমূলক অপরাধ- এমনটিই মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন ‘রাইজ’ এর প্রতিষ্ঠাতা আমান্ডা গ্যুয়েন। তিনি বিবিসি-কে জানান, ফেডেরাল সংস্থাগুলো এমনকী এশীয়-আমেরিকানদেরকে স্থানীয় সংখ্যালঘু হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় না।
মহামারীর শুরু থেকে যারা এশীয় আমেরিকানদের ওপর হামলা করেছে তারা আমাদের মধ্যে কোনও তফাত করতে পারেনি এবং আমরা ক, খ, গ যাই হই না কেন তাতে তাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, বলেন গ্যুয়েন।
যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের অপরাধগুলো কমাতে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নতুনত্বও প্রয়োজন বলে জানান তিনি। ‘পদ্ধতিগতভাবে আমাদেরকে হিসেবের বাইরে রেখে আসা হয়েছে অনেকদিন ধরে। এখন আমাদের সমস্যাগুলো সামনে শুরু করেছে। মানুষ চাইলে নিজেরেই সচেতনভাবে আমাদের সম্পর্কে শিক্ষা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ানো শুরু করতে পারে,’ বিবিসি-কে বলেন গ্যুয়েন।










