দিনের মধ্যাহ্ন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সময়। সকালে শুরু হওয়া কাজের সারাংশ সন্ধ্যার বর্ণিল গোধূলিলগ্নে সাফল্য ও অসাফল্যের একটা চিত্র ভেসে ওঠে। মানুষ নিজের ক্ষমতাকে যাচাই–বাছাই করে মধ্যাহ্নে, সূর্যের প্রকট উজ্জ্বল আলো যখন পৃথিবীতে স্থির। লেখকরা একটা নতুন লেখার চিন্তা ভোরের আলো থেকে মধ্যাহ্ন সময় পর্যন্ত নানা চড়াই–উৎরাই পার করে সন্ধ্যা অথবা গভীর রাত অবধি জন্মের শুভক্ষণ বিবেচনা করে। আবার কিছু সংখ্যক লেখক সারারাত চিন্তায় ডুবে থেকে সকালের দিকে চিন্তার ঝোলাটা নামিয়ে ফেলেন। তথাপি একটি দিনের মধ্যাহ্ন এক অনিবার্য সত্য ও সুন্দরের মুহূর্ত। সারাদিনের কাজের মোট সারাংশের একটি নমুনা দিনের শেষে কী হতে পারে এমন ধারণা ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, লেখক কবি গবেষক পেয়ে যায়। সৌর সময় অনুযায়ী মধ্যাহ্ন দুপুর ১২ টা ১২ মিনিট। সূর্যের মধ্যাহ্ন হল এমন সময় যখন সূর্য স্থানীয় আকাশের মধ্যমরেখাতল বরাবর অবস্থান করে। এটি সে– সময় যখন সুর্য আকাশে তার আপাত সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায়। সৌর সময়ের বাহিরে একটা প্রচলন অনুমিত ধারণা গড়পড়তা বাঙালির, মধ্যাহ্ন হল ১২ টা থেকে ১ টা। সে যা–ই হোক, সৌর মধ্যাহ্ন যেমন আমাদের চিন্তার জগতে প্রভাব ফেলে, সাহিত্যের মধ্যাহ্ন আমাদের অন্তর্লীন অনুভবে গভীর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে গত তিন দশক অবধি।
একটা ছোট পত্রিকা নামেমাত্র ক‘টি বিজ্ঞাপন নিয়ে যাত্রারম্ভ করে ১৯৯৫ সালের জুন মাসে। বাংলা ভাষার পঞ্চাশের অন্যতম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর আত্মা বিহীন নিথর দেহ তখন শ্মশানের পুণ্য আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল অনন্তলোকে পাড়ি জমান। কবির মৃত্যু সংবাদ দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়লে চতুর্দিকে শোক ও বিষণ্নতা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবিদের মধ্যে ৩০ এর জীবনানন্দ ও পঞ্চাশের শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভিন্ন এক অবস্থান ছিলো এদেশের তরুণ কবি ও বিজ্ঞ সাহিত্য মহলে। আমরা তখন শক্তির বহুল পঠিত কবিতা; যেতে পারি কিন্তু কেন যাব, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, জরাসন্ধ, একবার তুমি, দাঁড়াও কবিতাটি, পাঠ করছি যত্রতত্র ; ‘যেমন এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, এবং ভালবেসে দাঁড়াও / মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’ শক্তি‘র উচ্চারণ যখন এরকম উথাল–পাতাল আমাদের চিন্তা ও মননের গভীরে হঠাৎ আশির দশকের বাংলা ভাষার অন্যতম কবি ওমর কায়সার শক্তি কে নিয়ে সত্যি কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলেন শক্তি বন্দনায়। অচিরা পাঠচক্র তাৎক্ষণিক আয়োজন করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মরণসভা। সেদিন সে শোকের মুহূর্তে কবিতা পড়েন, কবি আবুল মোমেন, তপন জ্যোতি বড়ুয়া, ওমর কায়সার, সেলিনা শেলী, নূরুন্নাহার শিরীন, মাইনুল হাসান চৌধুরী, হোসাইন কবির, রিজোয়ান মাহমুদ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ার, আবু তাহের মুহম্মদ, সাহিদ উদ্দিন আহমেদ, অনুপ সাহাসহ আরো অনেকেই। শক্তিকে নিয়ে আমার পঠিত কবিতাটি কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী চেয়ে নেন পূর্বকোণ সাহিত্য পাতার জন্য। যথারীতি পরের শুক্রবার সেটি পূর্বকোণ পত্রিকায় ছাপা হয়। তৎপরবর্তী গভীর শোকাচ্ছন্ন শক্তির প্রজ্বলন্ত ছাই থেকে জন্ম নেয় কবি ওমর কায়সার সম্পাদিত প্রথম মধ্যাহ্ন শক্তি সংখ্যা ১৯৯৫ জুন মাসে। আমি ও কবি ওমর কায়সার মিলে শক্তির একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার রচনা করি। কল্পনায় কবিকে ধারণ করে প্রশ্ন ও উত্তর সবটাই আমাদের মস্তিষ্কজাত, তবে সমুদয় ব্যাপারটি আমাদের উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ, গভীর অনুসন্ধিৎসা ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে। সাক্ষাৎকারটি কথার ওজনসহ ভিন্ন কিছু হওয়াতে বেশ সমাদৃত হয়। সাহিত্য অনুরাগীরা সাক্ষাৎকারটি খুব পছন্দ করে। ছোট পত্রিকার চরিত্রানুযায়ী মধ্যাহ্ন লাগাতার প্রকাশিত হয় নি। আবার জাতির ব্যাপক দুঃসময়ে মধ্যাহ্ন চুপচাপ কখনো বসে থাকেনি। মধ্যাহ্ন প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা–কে কেন্দ্র করে যখন দেশে কুচক্রী মহল দাঙ্গা সংঘটিত করার লক্ষ্যে একেকটা বুদ্ধমূর্তি ভাঙছে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মদতে ইহুদি কর্তৃক অত্যাচারিত নিগৃহীত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মধ্যাহ্ন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে। আন্তর্জাতিক বিপন্ন মানবতার ভরসার জায়গাকে পূর্ণতা দিয়েছে এই পত্রিকা। অর্থাৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটময় মুহূর্তে মধ্যাহ্ন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। মানবিক বিপন্নতা বিপর্যয়ে মধ্যাহ্ন এক পা এগিয়ে থাকা পত্রিকা সব সময়। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও দৃঢ়তার কারণে মধ্যাহ্নকে ঘিরে একটা লেখকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। আবার এই ছোট পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য তরুণদের উন্মাদনা দেখেছি। তরুণদের জায়গা দেয় নি তা–ও না। প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান তরুণদের ভালোবেসে জায়গা করে দিয়েছে পত্রিকাটি। যাদের অনেকেই আজ স্টার লেখক সাহিত্যাঙ্গনে। দেশে আশি নব্বুই ও শূন্য দশকে অনেক ছোট পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ–সব পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছোট কাগজ; লিরিক, চম্পকনগর, মধ্যাহ্ন, জোড়াসাঁকো, একবিংশ, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, সুদর্শনচক্র, দুপুরলতা, পুষ্পকরথ, ধলেশ্বরী, অর্চনা, চাষী, কাদামাটি, ইস্পাত, অন্তরীপ, কবিকৃতি, জীবনানন্দ, খড়িমাটি, ঘুড়ি, পলিমাটি, আকর, মঙ্গলসন্ধ্যা, দ্রষ্টব্য, অরুন্ধতী, রক্তবীজ, প্রান্ত, প্রেক্ষণ, প্রসূণ, শ্রাবণের আড্ডা, শব্দসাঁকো, প্রবাহ, জলঘড়ি, অর্ক, দ্বিতীয় চিন্তা, দ্রাবিড়, বাতিঘর, ফলক, স্বাতন্ত্র্য, ঢেউ, উত্তর আধুনিক, উচক্র, মূলধারা, কথামৃত, দ্রোণাচার্য, পাঠক্রম, চোখ আড্ডারু, সমন্বয় খড়কুটো। উল্লিখিত এই সব পত্রিকার মধ্যে লিরিক, মধ্যাহ্ন, সবুজ আড্ডা, শালুক, পুষ্পকরথ, অনিয়মিত হলেও বেরুচ্ছে। এখন নিয়মিত পত্রিকার মধ্যে আন্দরকিল্লা, অনন্য ধারা ও শিল্পশৈলীসহ আরও বেশ কিছু পত্রিকা চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। উপরোল্লিখিত পত্রিকাত্রয় লিটল ম্যাগ নয়, পাঁচমিশালি বিষয়সহ এতে সাহিত্যের কন্টেন্ট থাকে সুচারুভাবে। ফেসবুক সংস্কৃতি বলতে গেলে লিটল ম্যাগ চর্চা স্তব্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু সাহিত্য ম্যাগাজিন গ্যাটআপ, মেকআপ এবং প্রচ্ছদের চাকচিক্যসহ দারুণ দামী অফসেট কাগজে মুদ্রিত হয় নিয়মিতভাবে এবং চট্টগ্রাম থেকে উক্ত ৩ টি পত্রিকা নিয়মিত পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ফেসবুক সংস্কৃতি মূলত কমিটেড ছোট কাগজ প্রকাশনার আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। পূর্বে যে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সমাজ পরিবর্তনের দর্শন নিয়ে পত্রিকা বেরুতে দেখতাম তাতে ভাটা পড়েছে। মূলত এখন কম্প্রোমাইজিং দর্শন। ফেসবুক গড়পড়তা খারাপ ভালো সবাইকে সমানভাবে ধারণ করছে। সমাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ফেসবুক লেখকের লাইক পাওয়া কদর বেশি। বাহারি রঙের ছবি দিয়ে সাহিত্য করা ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। ভালো ও উত্তীর্ণ সাহিত্য নির্ণয় করা খুবই কঠিন এখনকার সময়ে।
এতসব ছোট কাগজের মধ্যে ‘মধ্যাহ্ন’ এর অবস্থান কোথায়? প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সহজ নয়। উত্তর ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে দাঁড়িয়ে একটা ছোট কাগজ সমাজ বিনির্মাণে কী ভূমিকা রাখছে! এ–ই প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর: একটা অনুভূতিময় পক্ষপাতহীন নির্ভরশীল উত্তীর্ণ সাহিত্য কাঠামো দাঁড়ানোর চেষ্টায় মধ্যাহ্ন‘র ভূমিকা প্রবলতর। কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক মধ্যাহ্ন সম্পাদক ওমর কায়সার বলেন, ‘যে কোনো অন্ধকার, হিমযুগ, মহাপ্লাবন অথবা মধ্যযামে কবিতার সূর্য থাকে কবির মধ্যগগনে। দিনের সকল সময় কবিতার মধ্যাহ্ন সময়। কবিতার কাগজের নাম তাই ‘মধ্যাহ্ন’ তো হবেই। শক্তির শ্মশানের আগুনে জন্ম মধ্যাহ্নের। দীর্ঘ চারদশক ধরে পুরোনো সংস্কার, মূল্যবোধ, শব্দপদ্ধতি, মাপা জীবনের ছক, কূপমণ্ডুক মধ্যবিত্ত জীবন যাপনকে পুড়িয়ে মারার জন্য যে আগুন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় জ্বালিয়েছেন তার আলোয় জন্ম নিতে চেয়েছিল মধ্যাহ্ন। কবির প্রয়াণে ব্যথিত আবেগ তাঁর স্মরণে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছিলাম তখন ‘মধ্যাহ্ন নিয়ে আমাদের তেমন দূর পরিকল্পনা ছিল না। এটি প্রকাশিত হচ্ছে সময়ের তাগিদেই। প্রথম সংখ্যা শক্তিকে নিয়ে প্রকাশের পর দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য পাঠকের চাহিদা তৈরী হয়। অনেকেই তাগাদা দিতে থাকেন দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের জন্য। সময়ের সাথে সাথে আমরাও সেই তাগিদ অনুভব করেছিলাম’
পাঠকের তাগাদা এখনো কমেনি। অনুভূতির আতর গন্ধ নাকে চুবিয়ে সম্পাদক মহোদয় ঘটা করে মধ্যাহ্নের দুটো সংখ্যা প্রকাশ করলেন। আগস্ট ২০২২ প্রয়াত কবি শাহিদ আনোয়ার সংখ্যা। অনেক সমৃদ্ধ আয়োজনে ভরা এই সংখ্যাটি পাঠক মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং আট মাসের মাথায় ২০২২ সালে রচিত দেশের বিখ্যাত ৫৫ জন কবির ৫৫ টি কবিতা নিয়ে ২০২৩ এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হল মধ্যাহ্ন কবিতা সংকলন। কবি ওমর কায়সার ও মধ্যাহ্ন এক ও অবিভাজ্য সত্তা। সিমেন্টটেড রিয়েলিটি বালু ও ইটের রসায়ন অথবা সাহিত্যের নন্দনকানন দেখলে, নদীর জল ও জালের সম্পর্ক। মধ্যাহ্ন সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে সব প্রতিকূল মুহূর্ত–কে জয় করে। কবিতা হোক কবির স্বপ্নালোকের চাবি, নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত মানুষের শৈল্পিক হাতিয়ার।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক