অন্তর্বর্তী সরকার : জনগণের প্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ

রশীদ আহমেদ চৌধুরী | সোমবার , ১২ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

নোবেল বিজয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে দেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গত তিন দিন কার্যত দেশে কোনো সরকার নেই। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছেন। সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র মোর্চার দু সমন্বয়ক মুহাম্মদ নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইঁয়া নতুন সরকারের সর্বকনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসাবে যুক্ত হয়েছেন। যা দেশের নতুন ইতিহাস। আমরা নবগঠিত সরকারকে স্বাগত জানাই। নতুন সরকারকে সর্বক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের সর্বস্তরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ভেঙে দেয়া হয়েছে। সেগুলো সংস্কার করে কার্যকর করার কাজটি সহজ নয়। উপরন্তু সরকারের কাছ থেকে জনগণের প্রত্যাশাও অনেক। যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে সরকারকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে চ্যালেঞ্জ যেমন আছে তেমনি রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ মুহূর্তে সরকারের সামনে নিম্নলিখিত চ্যালেঞ্জগুলো দৃশ্যমান।

. আইনশৃংখলা : গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান আন্দোলনে শত শত লোক নিহত আহত হয়েছে। লুটপাট, ভাংচুর, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সংক্ষুব্ধ জনতা পুলিশকে আক্রমণ, হত্যা করেছে। থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। থানা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। থানায় বসে কাজ করার আসবাবপত্র সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। থানার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। নিরাপত্তার অভাবে পুলিশ সদস্যগণ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদেরকে কাজে ফিরিয়ে আনা নিরাপত্তা বিধান করা, তাদের মনোবল বৃদ্ধি করা, থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা সচল করা সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি।

. অর্থনীতি পুনরুদ্ধার : উচ্চমূল্যস্ফীতি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট, আস্থাহীনতা, রিজার্ভের মজুদ ক্রমাবনতী, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, ঋণখেলাপী, অর্থপাচার, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি হ্রাস, বন্ধ শিল্পকারখানা খুলে দেয়া বর্তমানে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দেশে খাদ্য দ্রব্য মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১০% শতাংশের উপরে। ননফুড আইটেমের মূল্যস্ফীতি ৯.% শতাংশের উপরে। জাতীয় মজুরী বৃদ্ধি হার ৭.% শতাংশ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ার ফলে জনজীবনে চরম দুর্ভোগের কারণে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে এ সংকটের সমাধান দরকার। দ্রব্যমূল্য সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা খুব জরুরি।

. ন্যায় বিচার: আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে দলীয়করণের কারণে গত ১৫ বছর জনগণ ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সংবিধানে উল্লেখিত মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ফরমায়েশি বিচার রায় সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। বিচারপতি ও বিচারক নিয়োগে বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। পছন্দের লোকজনকে বিচারক ও জজ নিয়োগ করায় সংবিধান লংঘিত হয়েছে। শপথবদ্ধ বিচারকলীগ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ফলে বিচারকদের কাজ কর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নষ্ট হয়েছে। সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে বিচারবহির্ভুত যে সকল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচারবিভাগীয় তদন্তপূর্বক যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এ সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ।

. নির্বাচন ব্যবস্থা: নির্বাচন ব্যবস্থার সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনকে তামাশা ও প্রহশনে পরিণত করে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। দিনের ভোট রাতে করা হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জনগণ ভোট দিতে পারেনি। উন্নয়নের নামে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।

. জটিল রাজনৈতিক পরিবেশ: নেপথ্যে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু বিস্তৃত হবে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের মেয়াদ বিলম্বিত হলে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়বে। যার অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ রাষ্ট্র ক্ষমতায় বাহিনীর স্থায়ী অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে উঠবে। তবে সুখের খবর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মধ্যে আপাতত এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জাতীয় জরুরি মুহূর্তে সেনাবাহিনী উচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যা দেশবাসী চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে, ছাত্রজনতার রক্তের বিনিময়ে আজকে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। এ আন্দোলনের একক দাবিদার ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ। তারা তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি চাইবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীজন হতে চাইবে। যার নমুনা স্বরূপ দুজন সমন্বয়কে সরকারের উপদেষ্টা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইবে। অন্যদিকে বিএনপি জামাত বাম রাজনৈতিক দল সহ সহযোগী অন্যান্য দলগুলো আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে ত্যাগ স্বীকার করেছে। স্বৈরাচার পতনে ভুমিকা রেখেছেন। তারা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। উপরোক্ত বিভিন্ন পথ ও মতের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর পরস্পর বিপরীতমুখী দাবিদাওয়াগুলো সমন্বয় করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ। আমরা সরকারের সফলতা কামনা করছি। দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কামনা করছি। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি।

লেখক: আয়কর আইনজীবী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি চায় নগরবাসী
পরবর্তী নিবন্ধতৃণমূলের বড় সাংবাদিক ও শিক্ষা সংগঠক জালালউদ্দিন আহমদ