আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই দাবি আদায়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বিভিন্ন পক্ষ। ঢাকা শহর যেন পরিণত হয়েছে দাবি আদায়ের শহরে। পত্রিকায় সংবাদ বেরোয়, প্রতিদিনই কোনও না কোনও দাবি নিয়ে রাজপথে নামছেন আন্দোলনকারীরা। সচিবালয় থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব, শাহবাগ, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনেও নিজেদের দাবি আদায়ে সমবেত হচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। বিভিন্ন দাবি আদায়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনেও সমবেত হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। এ কারণে ওই এলাকায় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আমরা দেখি, চাকরি জাতীয়করণ, স্থায়ীকরণ, পুনর্বহাল, পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারসহ নানা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বঞ্চিতরা। তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ আনসার, বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার, শিক্ষানবিশ আইনজীবী এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি কাম প্রহরীরা। এমনকি প্যাডেল চালিত রিকশাওয়ালাও। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এতদিন কেউ কোনো দাবি জানায়নি। এখন সুযোগ পেয়ে যে যার মতো রাস্তা বন্ধ করে দাবি জানাচ্ছে। মনে হয় দাবি আদায়ের শহর এই ঢাকা।
আসলে আমাদের বুঝতে হবে কোন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছে। সচেতন নাগরিকের জানা আছে যে, ৫ আগস্টের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এর আগে যে সব অনিয়ম হয়েছে, তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি বহুলাংশেই ছিল অস্বাভাবিক। শুধু অস্বাভাবিক বললে হবে না, ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। সে ক্ষেত্রে জননিরাপত্তার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনও বলা যাবে না জননিরাপত্তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিশ্চিত করা গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো স্থিতিশীল সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ জননিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ মসৃণ করা। দেশের ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকার শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। একদিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ সুগম করা অন্যদিকে অনিয়ম–দুর্নীতিসহ নেতিবাচক সবকিছুর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করা–এসব ব্যাপারে তাদের অধিক মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। তাঁরা বলেন, ‘আমরা স্পষ্টতই মনে করি, যেকোনো কার্যসিদ্ধির জন্য যেমন যথাযথ সময় দরকার তেমনি এর অনুকূলে সে–রকম পরিবেশ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। আমরা আহ্বান রাখব, দাবিদাওয়া আদায় করতে গিয়ে যেকোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা এমন কিছু করবেন না, যাতে জনবিড়ম্বনার পাশাপাশি সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।’
আজ চারদিকে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সচিবালয়ে কার্যক্রমে চলছে স্থবিরতা। পদায়ন ও পদোন্নতি প্রত্যাশায় কেউ আছেন, কেউ আছেন বদলি ও ওএসডি আতংকে। অন্যদিকে, ১৫ বছরের সুবিধা বঞ্চিতরা আছেন আন্দোলনে। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কী করবে– কোন্ দিকে যাবে। সবাই সুযোগ চায়, সবাই পদ–পদবি চায়। কিন্তু সরকারকে একটু সময় দিতে হবে তো!
প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে দেশের প্রথম সারির এক সাংবাদিক নেতা বলেছেন, দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারকে অন্তত এক বছর সময় দিতে হবে। ১৭ বছর মানুষ কথা বলতে পারেনি, এখন তারা কথা বলতে পারছে। কিন্তু তাদেরকেও বুঝতে হবে, পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের কোষাগারকে একদম শূন্য করে গিয়েছেন। এখন চাইলেই তো সবার দাবি পূরণ করে অর্থসংস্থান করা সম্ভব নয়। তাই সবাইকে ধৈর্য ধরে সরকারকে স্থিতিশীল হওয়ার সময় দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আমরাও তাঁর মতো সবার নাগরিক অধিকারের পূর্ণতা চাই। আমরা আশা করি, কেউ তার নায্য অধিকার কিংবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রাখতে হবে, ‘জনবিড়ম্বনা এবং সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে পরিস্থিতি বৈরিতার গণ্ডিতেই থেকে যায়।’ দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে প্রত্যেক স্তর থেকে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত। সরকার দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারলে জনপ্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে। আশা করি, যাঁরা আন্দোলন করছেন, দাবি–দাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে যাচ্ছেন, তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা–আপনারা সবাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। দেখবেন, আপনারাই লাভবান হচ্ছেন। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে জনপ্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়।