নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর আপামর মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করলে দেশে যে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণের লক্ষ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উঠে আসে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। একজন নোবেলজয়ী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বজুড়ে ড. ইউনূস সমাদৃত। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এতো বেশি, তাকে মূলধন করে বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরা সহজ হবে আশা রাখি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন অনেক কাজ। সদ্য সাবেক সরকারের প্রতি রোষের প্রকাশ দেখাতে গিয়ে দেশে যেভাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নৈরাজ্য চলতে দেখা গেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রথমেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হবে ‘আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাংলাদেশের এক ক্রান্তিকালে দায়িত্ব নেওয়া নতুন সরকারকে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে অকার্যকর হয়েছে, সেগুলোকে সংস্কার করে কার্যকর করার কাজটি সহজ নয়। তাছাড়া এই সরকারের কাছে সব মহলের প্রত্যাশাও থাকবে অনেক বেশি। যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রাধান্য ঠিক করে তাঁরা সেই কাজগুলো নিশ্চয় করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং পুলিশ ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।’ আমাদের কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। যদিও প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ গ্রহণের আগে বলেছেন, ‘আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন যে দেশে কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।’ যে সরকার হবে তা মানুষকে রক্ষা করবে, এ কথা বলেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সম্পদ নষ্ট করছে। নিয়ে যাচ্ছে। অফিস–আদালতে আক্রমণ করছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমদিয়া–সবার ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের অংশ, আমাদের বিষয় না। আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন।’ প্রত্যাশার বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। দেশের জনগণ দেখতে চায়, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যে জঞ্জালের পাহাড় গড়ে উঠেছে, তা থেকে গণতন্ত্র মুক্ত করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে যেন তার প্রকৃতরূপে দেখতে পায় মানুষ। সামনের দিনগুলোয় ইতিবাচক কিছু দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দেশ। সেই পথে আমরা হাঁটতে পারি কি না, সেটাই দেখা দরকার। গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয় বলেই সত্যিকারের অর্জন নিয়ে ভাবতে দ্বিধান্বিত হয় মন। যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলই গণতন্ত্রকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে। বলপ্রয়োগের ভাষাকেই গণতন্ত্রের ভাষা বলে অনুবাদ করা হয়েছে।’ যে তরুণরা আন্দোলন করে এই সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এই মুহূর্তে সরকারের একটি কাজ হলো তাদের জন্য কিছু করা। সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো দেশে লাখ লাখ বেকার তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এতে করে দেশের তরুণ সমাজ বিদেশমুখী হওয়া কমিয়ে বাংলাদেশকেই এগিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে। সর্বোপরি, দেশের শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলা ব্যতীত যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চাই শিক্ষাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিবেচনা করে নতুন সরকার ছাত্র–শিক্ষক–জনতার ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দেবে। বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিনের অপশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার– এসব বিষয়ে মানুষ একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা প্রতিহত করে একটা বিজয় অর্জন করেছে। এখন সরকারের কাছে বেশিরভাগ মানুষের দাবি অপশাসন, দুঃশাসন দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাহী বিভাগসহ সব বিভাগ যেন প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকে। ব্যবসা বাণিজ্যে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল, তা যেন ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মূল কথা, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ অনেক কিছু আশা সকলের। আশা করি ধীরে ধীরে সব বাস্তবায়ন হবে।