অনুসূর্যকে লেখা রূপকথারা

জেসিকা আক্তার জেসি | শুক্রবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ

‘অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা’ ঠিক যেন নিজের সাথে নিজে বলা কথার মতোন। হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছ, কোন একটা পরিচিত পাখি, নদীর ঢেউ কিংবা ঝরে পড়া শুকনো কোন পাতার সাথে নিজের কথা, কল্পনার কথা, বাস্তব-অবাস্তব সবকিছুর মিলনে সৃষ্টি হয়েছে ‘অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা’ তেরোটা উপাখ্যান। চলুন একটু গল্পের ভিতর হেঁটে আসি..
‘নিমফুলের দেশ’ গল্পে ফাতেমার জীবন পড়তে পড়তে কোথাও একবার মনে হয়নি ফাতেমা নিজের স্বামীকে পুড়িয়ে ফেলে কোন অপরাধ করেছে। সে যখন তার স্তনে মধু মাখিয়ে সাথে ফ্রিজিয়াম ট্যাবলেটের গুড়ো মিশিয়ে আব্দুল্লাহকে খেতে দেয় তখন আমার এতোটুকু কষ্ট লাগে না, দুঃখবোধ হয় না। ফাতেমাদের বুকের ভিতর যে হুহুপাখি হু হু ডাকে যে সমুদ্র উত্তাল ঢেউয়ে ফেটে পড়ে সারাটা বছর সে ফাতেমারা যখন অসাধ্য সাধন করে তখন আমি আনন্দিত হই।
‘আবলুসের কাঠের চেয়ার’ গল্পে ঝড়ের তীক্ষ্ম থাবায় যখন ঘরবাড়ি উড়ে যায়। মানুষ আটকে তালগাছে থাকে। মাছের পেটে পাওয়া যায় একজন নববধূর হাতের মধ্যমা আঙুল। গাছের শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। পাশের নদীটাও উল্টে যায় এমন তখন ‘আবলুসের কাঠের চেয়ার’ ভেসে আসে। বছরখানেক পরে যখন একজন বু্‌ড়ি এসে চেয়ারটা নিয়ে যায়, নিশ্চয়ই এটা তার স্বামীর শেষ স্মৃতি ছিল আর জুতোটা হয়তো তার বংশের শেষ প্রদীপ এইজন্যই বোধহয় সে গলায় মালা বানিয়ে পরে নিল।
‘শঙ্খমালার শেষ লাইন’ গল্পে নির্ঝর যদি শিরোপাকে জীবনানন্দের
‘তুমি কেন বহু দূরে- ঢের দূর-আরও দূরে- নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ
তুমি কেন কোনদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বলো নাকো একটিও কথা;’
এই দুটো লাইন না লিখত তবে হয়তো দেখতাম নির্ঝর শিরোপাকে চুমো খেতে খেতে ঢুকে পড়ছে ঘন লেবুগাছের ভিতর। হয়তো শিরোপার স্বামীটা কেমন দেখার জন্যে আর কোনো নির্ঝর ছয় বছর পরও একটু অপেক্ষা করতো না তখন।
‘লুপ্ত নামের দাগ’ গল্পটা পড়তে পড়তে আমার কেনো জানি হুমায়ুন আজাদের ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ উপন্যাসটা মনে পড়ছিল। মানুষ মূলত এক দাগের উপর আরেক দাগ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে জন্মায়। কোনকিছু অস্বাভাবিক নয় যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। সম্পর্ক বড় জটিল ধাঁধা এর কোন উত্তর নেই..যাকে টেনে নিয়ে যেতে হয় কবর পর্যন্ত! আচ্ছা জেসি নামের মেয়েরা সব কেন হারায়?
ইচ্ছেকুয়া,দীর্ঘশ্বাসের পাখি, যখন গায়েত্রী ছিলাম, চব্বিশ আগস্টের সন্ধ্যা পড়তে পড়তে আমিও যেন আমার মনের ভিতর থাকা অনুসূর্যকে বলছিলাম নিজের সমাজের-রাষ্ট্রের, কল্পনার কথা। আর হুহু পাখির ডাক শুনতে শুনতে বৃষ্টির মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসা লেবু গাছের গন্ধে বুকের পাথরটাকে সরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখনও ফাতেমার সমুদ্রে, কখনও রেণুর বুকে, কখনও সুমনের আলতামাখা পায়ে কিংবা ওই চিত্রচিল্পীর মতোন যে মাঝিটার গলায় ক্ষুর বসিয়ে নদীটা লাল বানিয়ে ফেলল তাদের কান্না, যৌবন, ইচ্ছে, তিক্তজীবন নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে কাঁদতে লাগলাম। যতো দৌড়াই ততো পথ বাকি থেকে যায়, এই কান্নার পথ হয়তো কখনও শেষ হবার নয়…

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকাশে বোমা, পাতালে আশ্রয়
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের লোকগান এবং মহি-আল-ভাণ্ডারী