প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের মেয়াদকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মালিকানাধীন জায়গা ও স্থাপনা বরাদ্দে অনিয়ম খুঁজতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বৃহষ্পতিবার কমিটি অনুমোদন দেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। আগামীকাল রোববার এ বিষয়ে অফিস আদেশ জারি হওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গঠিত তদন্ত কমিটিতে প্যানেল মেয়র-২ ও বাগমনিরাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে আহ্বায়ক ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন আইন কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন, নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব কুমার দাশ ও সহকারী এস্টেট অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন। কমিটি গঠনের বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে তো অনেক জায়গা। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন দেখবেন। একটু সময় লাগতে পারে। তাই সময় নির্ধারণ করে দিইনি।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ১৮০ দিনের জন্য ২০২০ সালের ৬ আগস্ট প্রশাসকের দায়িত্ব নেন খোরশেদ আলম সুজন। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি এ মেয়াদ পূর্ণ হয়। মেয়াদকালে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২টি জায়গা ১০ জনকে বরাদ্দ দেয়া হয়। যার পরিমাণ ১৭ হাজার ১৮৮ বর্গফুট। এলাকা ভেদে প্রতি বর্গফুট সর্বনিম্ন এক টাকা ৮০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৮৫০ টাকায় মাসিক ভাড়া ধার্য করা হয়। বরাদ্দ পাওয়া ১০ জনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও তাদের পরিবারের সদস্য আছেন ছয়জন। যারা সাবেক প্রশাসকের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত।
এদিকে জায়গা বরাদ্দ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা হয়। অনেকে বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় অনিয়মেরও অভিযোগ করেন। এ প্রেক্ষিতে গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চসিকের বর্তমান পর্ষদের তৃতীয় সাধারণ সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কীনা তদন্তে কমিটি গঠনের জন্য সংস্থার প্রধান নির্বাহীকে নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে কিছু করা হচ্ছে না। এটা মনে করা হবে ভুল। কোথায় কি জিনিস দেয়া হয়েছে, কাকে দেয়া হয়েছে, সঠিকভাবে দেয়া হয়েছে কীনা সেগুলোর কর্পোরেশনের স্বার্থেই নলেজে আসা উচিত।
মেয়র বলেন, তদন্তে কোথাও অনিয়ম পাওয়া গেলে, ফুটপাতের উপর কোনো স্থাপনা থাকলে সেগুলো কর্পোরেশন ও নাগরিক স্বার্থে অবশ্যই বাতিল করে দিবো। ফুটপাতের অনেক জায়গা লিজ দেয়া হয়েছে। যেমন আমানত শাহ (র:) এর মাজারের সামনে ফুটপাত লিজ দিয়েছেন। এমন কিছু তো আমরা জনস্বার্থে এক্সসেপ্ট করবো না।
এর আগে মেয়র গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, কর্পোরেশনের আয় বাড়াতে নিকট অতীতে গৃহিত কিছু কিছু কাজ ও বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে। এসব বিষয় জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট হওয়া দরকার। কোন অভিযোগ যদি সত্য হয় তা উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ যেমন প্রয়োজন তেমনি যদি ভিত্তিহীন হয় সেটিও তদন্ত কমিটি স্পষ্ট করবে। তাই তদন্ত হলে কারো অখুশী হওয়ার কথা না।
এদিকে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের পর পর সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলেন, দায়িত্ব পালনকালে জানতে পারি কর্পোরেশনের বিভিন্ন জায়গা-সম্পত্তি বিভিন্নজনে লুটেপুটে খাচ্ছে। অনেক জায়গার কোনো হদিস ছিল না, কর্পোরেশনের রেকর্ডপত্রেও ছিল না। খুঁজে বের করে জায়গাগুলোকে সব নিয়মনীতি মেনে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্বল্প মেয়াদের জন্য ইজারা দিয়েছি। বেহাত জায়গা উদ্ধার এবং অ-রাজস্ব খাতের জায়গাকে রাজস্ব খাতে এনে আয় বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, আমার সময়কালীন সিটি কর্পোরেশনের জায়গা বরাদ্দের নিয়ম-নীতির কোনো ব্যত্যয় হয়নি। বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যারা সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছে, তারাই বরাদ্দ পেয়েছে। যা করেছি কর্পোরেশনের আয়ের খাতকে মজবুত করার জন্যই করেছি। এরপরও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে যদি কর্পোরেশন মনে করে, কোনোটাতে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে, তাহলে কর্পোরেশন চাইলে তা বাতিল করতে পারে।
এদিকে বরাদ্দ দেয়া জায়গাগুলোর মধ্যে পোর্ট কানেকটিং রোডের চৌ-রাস্তার উত্তর পূর্ব পাশে ৬০০ বর্গফুট খালি জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয় মীর আহমদকে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন এককালীন পেয়েছে ছয় লাখ টাকা। প্রতি বর্গফুট মাসিক সাড়ে ৯ টাকা ভাড়ায় বিআরটিসি মার্কেট সংলগ্ন ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে সেমিপাকা (২৮৯ বর্গফুট) ভবন বরাদ্দ দেয়া হয় আকতার হোসেনকে। প্রতি বর্গফুট সাড়ে তিন টাকা মাসিক ভাড়ায় মাদারবাড়ি অ্যার্পাটমেন্ট সংলগ্ন একতলা ২০০ বর্গফুট (কম-বেশি) ভবনের বরাদ্দ দেয়া হয় জুনায়েদ আহমদ চৌধুরীকে।
৪০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস ভবনের উত্তর ও পশ্চিম পাশে এক হাজার ৭৫৭ বর্গফুট খালি জায়গা সমীর মহাজন লিটনকে ব্যবহারে অনুমতি দেয়া হয়। প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ধরা হয় ১০ টাকা। ইউনুছ মিয়া মেটারনিটি সংলগ্ন এক হাজার ৬৪ বর্গফুট খালি জায়গা প্রতি বর্গফুট মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় খলিলুর রহমান নাহিদকে, ঝুমুর সিনেমা হলের উত্তর পাশে জয় পাহাড় মৌজায় ৫৪০ বর্গফুট খালি জায়গা বর্গফুট প্রতি মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় রাবেয়া বেগমকে, প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা মাসিক ভাড়ায় কে সি দে রোড গণশৌচাগারের পশ্চিম পাশে পরিত্যক্ত ৩৭৬ বর্গফুট খালি জায়গা জানে আলমকে, প্রতি বর্গফুট এক টাকা ৮০ পয়সা মাসিক ভাড়ায় মাদারবাড়ি ওয়ার্ড অফিস সংলগ্ন ৬ হাজার ৫৩৪ বর্গফুট খালি জায়গা খলিলুর রহমান নাহিদকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়া শাহ আমানত মার্কেটের সিঁড়ির উত্তর পাশে বারান্দায় ১৫৩ বর্গফুট খালি জায়গা মাসিক দুই হাজার ২৯৫ টাকা ভাড়ায় এবং শাহ আমানত মার্কেটের সামনে আইএফআইসি ব্যাংকের বারান্দার প্রথম তলার ছাদের ওপর ৩৯০ ফুট জাযগা মাসিক পাঁচ হাজার ৮৫০ টাকা ভাড়ায় মো. শাহাজাহান চৌধুরীকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।