বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর নানা খাতে দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এই দুর্নীতির উৎসমুখগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ থেকেই প্রতিনিয়ত দুর্নীতি নিরূপণ এবং নিবারণের কৌশল খুঁজতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা প্রবৃদ্ধি ও দুর্নীতির সামষ্টিক সম্পর্কের আর্থগাণিতিক বর্ণনার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং সুনির্দিষ্ট খাতের পারফরম্যান্সের ওপর এসব দুর্নীতির প্রভাব বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকাই দুর্নীতি বাড়ার বড় কারণ।
সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবনে যে দুর্নীতি বা অনিয়মের মুখোমুখি হচ্ছে, তা প্রতিরোধের বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছে দুদক। তারা তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, মাঠ পর্যায় থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ বেশি এসেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দুর্নীতির হাজার হাজার অভিযোগ করেছে।
বর্তমানে অনিয়ম ও দুর্নীতি কোন্ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে ৫ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। ‘২৮০ টাকার বেডশিট কেনা হলো ৭০০ টাকায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টারে বাড়তি দামে পণ্য ক্রয়সহ নানা অসঙ্গতি উঠে এসেছে। একে বলা হয়েছে, বাজারে ডিজিটাল থার্মোমিটার বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আইসোলেশন সেন্টারের জন্য কেনা হয়েছে ৭০০ টাকায়। একইভাবে আইসোলেশন সেন্টারটির জন্য ২৮০ টাকার বেডশিট ৭০০ টাকায়, ৩৫০ টাকার রাবার শিট এক হাজার ২০০ টাকায়, ৯৫০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভস এক হাজার ৮০০ টাকায় এবং ৪০ টাকার মগ কেনা হয়েছে ১৫০ টাকায়। বাড়তি দামে এসব পণ্য কেনা হয়েছে ‘মেসার্স এবি কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। দুই লটে প্রতিষ্ঠানটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকার মালামাল সরবরাহ করে। যদিও এবি কর্পোরেশন থেকে মালামাল সংগ্রহের পূর্বে ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যের দর সংগ্রহ করেছিল চসিকের ‘কন্ট্রোলার অব স্টোরস’ এর দপ্তর। ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ ডিজিটাল থার্মোমিটার, বেডশিট, হ্যান্ড গ্লাভস এবং মগসহ অন্যান্য পণ্যের দামের কোটেশন দিয়েছিল এবি কর্পোরেশনের চেয়ে অর্ধেক দামে।
আইসোলেশন সেন্টারের যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিতরণ ও স্থাপনে অনিয়ম অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বাড়তি দামে কেনাকাটার এ তথ্য ওঠে এসেছে।
খবরটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ কথা বলা বাহুল্য, হাতেগোনা কয়েকজনের কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের অর্জন ম্লান হতে বসেছে। এ অবস্থার অবসান চায় সরকার। সরকার মনে করে, আওয়ামী লীগ কোনো অপরাধী বা দুর্নীতিবাজের আশ্রয়স্থল বা প্রতিরক্ষা হতে পারে না। তাই এখন থেকে ঘটনার পেছনের ঘটনাও খতিয়ে দেখা হবে। কেউই ছাড় পাবে না। আমরা যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি ও অনিয়ম বিষয়ে তাঁর অবস্থান কঠোর ও অনমনীয়। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান অনড়। যার যার অপরাধ ও দুর্নীতি, দায়ভারও তার তার। দল বা সরকার কারও অপরাধের দায় নেবে না। এক্ষেত্রে কেউ দল বা সরকারের ভিতর বা বাইরের হতে পারেন। কাউকে ছাড় দেবেন না তিনি। কোনোমতেই আইনের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত করতে দেবেন না। দলের নাম ভাঙিয়ে যারা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় আছে, তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধ ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আপস নেই। যারা যেখানে উল্টাপাল্টা কিছু করছে তাৎক্ষণিক তাদের ধরা হচ্ছে। সে যেই হোক, দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন করোনাকালে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা এই সেন্টার ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবু অনিয়ম অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যেসব অসঙ্গতি উঠে এসেছে, তা দুঃখজনক। সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি তুলে ধরেও প্রশংসনীয় কাজ করেছে। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বাড়তি দামে পণ্য ক্রয় করে কার স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।