আমাদের বাংলাদেশে অবাক করা কিছু কাণ্ড ঘটে। তার একটি ঘটনার অবতারণা। আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে ৫ ফেব্রয়ারি’২০ সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি থেকে একটি প্রাইভেট কার চট্ট মেট্রো গ–১১–৮৬৫৩ (টয়োটা প্রভোক্স) চুরি হয়। চুরির পর গাড়ির চালক সীতাকুণ্ড থানায়একটি চুরির মামলা রজু করেন। প্রায় ১০ মাস পর সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ মামলাটির কোনো কূল কিনারা করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত পুলিশের ঐ চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে সিআইডিকে মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন একই বছরের ১৭ই ডিসেম্বর। তদন্তের প্রায় ৬ মাস পর সিআইডি জানতে পারে গাড়িটি হবিগঞ্জের এক ব্যক্তির কাছে আছে এবং তিনি সেটি নিয়ে চলা ফেরা করেন। পরবর্তীতে সিআইডি ঐ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে গাড়িটি ফেরত দিতে বললে তিনি বলেন, ২০২১ সালের ১৬ মার্চ তিনি হবিগঞ্জ আদালতে নিলামের মাধ্যমে গাড়িটি কিনেছেন। সেজন্য তিনি গাড়িটি ফেরত দিবেন না। এরপর সিআইডি পুলিশ গাড়িটির চুরির পূর্বাপর ঘটনা তদন্ত করে জানতে পারে সীতাকুণ্ড থেকে চুরির পর ১৯ ফেব্রয়ারি’২০ গাড়িটি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানা পুলিশ উদ্ধার করে পরিত্যক্ত অবস্থায়। পরে নবীগঞ্জ থানা পুলিশ মালিকানা যাচাইয়ের জন্য গাড়িটির ইঞ্জিন, চেসিস ও গাড়ির নম্বর উল্লেখ করে বিআরটিএ চট্টগ্রাম কার্যালয়ে পত্র প্রেরণ করে। কিন্তু বিআরটিএ চট্টগ্রাম অফিস গাড়িটির প্রকৃত মালিকের নাম ঠিকানা না দিয়ে একটি মোটর সাইকেলের (চট্ট মেট্রো ল সিরিয়ালের) মালিকের নাম ঠিকানা দেয়। যাতে মালিক হিসাবে আবদুল করিম নামে একজনকে দেখানো হয়। প্রাইভেট কারের বিপরীতে মোটর সাইকেলের মালিকের নাম ঠিকানা দেওয়া হলেও নবীগঞ্জ থানা পুলিশ তা এড়িয়ে গাড়িটি নিলামে বিক্রির জন্য মালখানায় জমা দেয়। সেখানেও গাড়িটির ইঞ্জিন, চেসিস ও রেজিষ্ট্রেশন নম্বরের সাথে বিআরটিএর পাঠানো তথ্য ও ঠিকানা যাচাই করা হয় নি। এরপর ১৬ মার্চ ২১ হবিগঞ্জ আদালত নিলামের মাধ্যমে গাড়িটি বিক্রি করে দেয়। এদিকে গাড়ির ড্রাইভারের করা মামলায় আদালত ১৩ ফেব্রুযারি ২২ তারিখে যে কোনো উপায়ে গাড়িটি জব্দ করতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব পুলিশকে নির্দেশ দেন। গত ৩১ অক্টোবর ২২ হবিগঞ্জের অসেরা গ্রামের স্কুল বাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে, পুলিশ ও বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা কিভাবে এতোবড় একটা ভুল (হয়ত ইচ্ছাকৃত) করেন? অথচ গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বিআরটিএ, চট্টগ্রাম অফিসে গেলে মানুষের হয়রানির শেষ থাকে না। নানা রকম উছিলায় মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তবে উৎকোচ দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। এই দপ্তরের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা বছরের পর বছর একই অফিসে চাকরি করে দালাল চক্রের সমন্বয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে।
এজন্য তারা অন্য কোথাও ট্রান্সফার হলে তদবির করে আবার এই অফিসে চলে আসে। নানা অনিয়মের পরও তাদের কোনো প্রকার জবাবদিহি বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না।
গত ৩রা অগাস্ট ২০২২ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানিতে একটি অনিয়মের অবতারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুক্তভোগী নুর চেহের বেগম (৮৭) ও তার ছেলে মিজানুর রহমান। নুর চেহের বেগম বলেন, তার স্বামী আলীম উল্লাহর ৩৮ শতক জায়গায় পৈতৃক বসতভিটা ছিলো বর্তমান চট্টগ্রাম নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায়। ১৯৮২ সালে সেই জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেজন্য আলীম উল্লাহকে ১৯৮২ সালের ১৯ শে মার্চ জমি থেকে উচ্ছেদের জন্য চুড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়। যদিও এর আগে ক্ষতিপুরণ বা আগাম কোনো নোটিশ পাননি আলীম উল্লাহ। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নোটিশ পাওয়ার পরদিন ২০শে মার্চ ভোরে মারা যান আলীম উল্লাহ। এর দুইদিন পর জন্ম হয় নুর চেহেরের ছেলে মিজানুর রহমানের। ভিটা থেকে উচ্ছেদের পর নুর চেহেরের ঠাঁই হয় এমপিবি পাশে তক্তারপোল এলাকায় ভাড়া বাসায়। বিধবা মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে অবতীর্ণ হন কঠিন জীবন যুদ্ধে। শুরু করেন ফুটপাতে কাপড় বিক্রি। বাড়তি আয়ের জন্য করতেন বিয়ে বাড়িতে মসলা বাটার কাজ। এরইমধ্যে প্রশাসনের ভুলে বা গাফিলতির জন্য ক্ষতি পূরণের টাকা তুলে নেয় একটি কুচক্রী মহল। কিন্তু হাল ছাড়েননি নুর চেহের বেগম। ৩৮ শতক জমির ক্ষতিপুরনের জন্য শুরু হয় তার ৪০ বছরের দীর্ঘ আইনী লড়াই। জমির মালিকানা ও ক্ষতিপূরণের জন্য ১৯৮৯ সালে আদালতের আশ্রয় নেন তিনি। ১৯৯০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর আদালত নুর চেহের বেগমের পক্ষে রায় দেন। এই রায় পাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯২ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন নুর চেহের বেগম। বন্দর কর্তৃপক্ষও একাধিকবার চিঠি দেন। বিষয়টি নিয়ে নুর চেহের বেগম, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ২০ বারের বেশি চিঠি চালাচালি হয়। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তখন নিউমুরিং জেটি নির্মাণের জন্য হালিশহর মৌজার ৭২.২৫ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়। যার ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা জেলা প্রশাসনকে পরিশোধ করা হয়। জেলা প্রশাসন ১৯৮৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর বন্দর কর্তৃপক্ষকে জমি বুঝিয়ে দেয়। এদিকে নুর চেহেরকে দেওয়া বন্দরের এক চিঠিতে বলা হয়, নুর চেহেরের স্বামী আলীম উল্লাহর বাবা সুলতান আহমেদের ওয়ারিশ পরিচয় দিয়ে আবুল খায়ের ও আবু ছৈয়দের পক্ষে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা হতে জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নেওয়া হয়। তারা এলএ শাখার কর্মরতদের সাথে যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে মূল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নেন। পরে এই টাকা উদ্ধারের জন্য ১৯৯৪ সালে জেলা প্রশাসন ছয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছয়টি সার্টিফিকেট মামলা করে, যা এখনো চলছে। ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ে লড়াই করতে গিয়ে ৮৭ বছরের বৃদ্ধা নুর চেহের এখন বিপর্যস্ত, ক্লান্ত ও অসুস্থ। জীবনের শেষ মুহূর্তে তার চাওয়া, ভিটা থেকে উচ্ছেদের ক্ষতিপূরণের টাকা ও পনর্বাসনের ব্যবস্থা যেন করা হয়। তবে ন্যায্য ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ৪০ বছর ধরে একজন বৃদ্ধা নারীর বিভিন্ন সংস্থায় ঘোরাঘুরি সত্যিই দুঃখজনক। সামাজিক অবিচার কোথায় পৌঁছেছে এটা তার প্রমাণ। অথচ এই ভুলের দায় প্রশাসনের। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, উচ্ছেদের নোটিশ দেয়া হলো একজনকে আর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলো আরেক জনকে। এটি কতো বড় অনিয়ম ভাবতেও কষ্ট হয়। যদিও এইজন্য সংশ্লিষ্ট শাখার কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা দিব্যি চাকরি শেষ করে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে সারাদেশে জমির জরিপের কাজ করা হয়। জরিপের অধিদপ্তরের কর্মচারীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে একটা নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করেন। কয়েকদিন একটা গ্রামে থাকায় গ্রামের স্থানীয় টাউট বাটপার ও প্রভাবশালী লোকের সাথে তাদের এক ধরনের সম্পর্ক তৈরী হয়। জরিপের মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীরা ঐসব টাউট শ্রেণির মানুষের সহযোগিতায় গ্রামের নিরীহ সহজ সরল প্রত্যেকটা লোক থেকে নির্দিষ্ট অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে। কেউ তাদের চাহিদামত উৎকোচ না দিলে একজনের জমি আরেক জনের নামে বা সরকারের নামে বা খাস হিসাবে তালিকাভুক্ত করে খসড়া খতিয়ান ইস্যু করে। কারণ সাধারণত বংশ পরম্পরার জমি, জমির দখল ছাড়া আর কোনো দলিল বা খতিয়ান থাকে না। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে জরিপের মাঠ পর্যায়ের ঐসব কর্মচারীরা। এরপর শুরু হয় মানুষের চরম দুর্ভোগ। প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন ধারায় মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ আজ নিঃস্ব। আমার গ্রামের পারিবারিক জমির ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। এতে দেখা যায় ২৮মার্চ ১৯৯৪ ইস্যু কৃত জমির খসড়া খতিয়ানে জমি উল্লেখ আছে ৫৩১ শতাংশ। পরবর্তীতে যখন চূড়ান্ত খতিয়ান আসে তখন দেখা যায় ৩৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৩৪ শতাংশ কম। যে ১৩৪ শতাংশ জমি খতিয়ানে কম দেখানো হয় তারমধ্যে বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত সম্পত্তি ৪ শতাংশ আর খরিদকৃত সম্পত্তি হলো ১৩০ শতাংশ, যা দলিলের মাধ্যমে রেজিস্ট্রিকৃত। মজার বিষয় হলো, বংশ পরম্পরার সম্পত্তিগুলো অন্যের নামে খতিয়ানভুক্ত করলেও খরিদকৃত সম্পত্তি কারে নামে খতিয়ানভুক্ত করা হয়নি। পরে সম্পত্তির জরিপের বিষয়ে খোঁজখবর করার জন্য জরিপ অধিদপ্তরের স্থানীয় অফিস, জোনাল অফিসসহ ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় অফিসে যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোর্টে মামলা করার পরামর্শ দেন। সে প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে কোর্টে মামলা করা হয়। এবার শুরু হয় আরেক বিড়ম্বনা। প্রথম দিন মামলার বিষয়ে আলোচনার জন্য উকিলকে নির্দিষ্ট অংকের ফি দিতে হয়। পরে মামলা দাখিল করার জন্য উকিলকে একটা বড় অংকের টাকা দিতে হয়। সেই থেকে বিগত চার বছরের অধিককাল প্রতি মাসে উকিলের ফিসহ লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। প্রতিমাসে মামলার নির্দিষ্ট দিনে কোর্ট আবার নতুন তারিখ দেন কিন্তু উকিলের ফি যথারীতি দিতে হয়। এরইমধ্যে একদিন সরকারি উকিল মামলাটিতে আপত্তি দেন। তবে প্রায় বছরেরও অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও সরকারি উকিল সরকারের পক্ষে কোনো তথ্য উপস্থাপন করেননি। হয়ত আরো অনেক দিন উনি কোনো তথ্য উপস্থাপন করবেন না, কিন্তু মামলাটি দীর্ঘায়িত হবে।
কারণ তাঁর পক্ষে উপস্থাপনের মত কোনো তথ্য আছে বলে মনে হয় না। সে জন্য এখনো মামলার কোনো ফয়সালা হয়নি।এক্ষেত্রে উকিলও মামলা দ্রুত শেষ করার জন্য কোনো আবেদন বা উদ্যোগ নেননি। কারণ মামলা যত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে ততই উকিলের ফি বাড়বে। এই মামলা নিয়ে কোর্টে যাতায়াত করতে গিয়ে দেখি জরিপ সংক্রান্ত হাজার হাজার মামলা কোর্টে চলমান। মামলার খপ্পরে পড়ে গ্রামের সহজ সরল দরিদ্র লোকগুলো আজ সর্ব শান্ত। অনেকে বছরের পর বছর মামলার খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ধারদেনা বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে মামলার খরচ চালাচ্ছেন। অথচ যারা জমির এই অনিয়মগুলো করেছেন, লাখ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন, তারা বাড়ি গাড়ি করে নিশ্চিন্তে চাকরি জীবন পার করছেন, কোনো রকমের জবাবদিহিতা ছাড়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট