এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে লকডাউনের কারণে ঈদযাত্রায় বন্ধ ছিল দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন। সরকারি বিধিনিষেধে সীমিত পরিসরে চলেছে ফেরি ও জেলায় জেলায় গণপরিবহন। এই সীমিত যান চলাচলের মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনা সবাইকে হতভম্ব করেছে। এসব দুর্ঘটনায় সড়কে ঝরে গেছে তিন শতাধিক প্রাণ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৪ দিনে (৭-২০ মে) দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৯টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩১৪ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৯১ জন। নিহতের মধ্যে ৪৩ জন নারী ও ২৮ জন শিশু রয়েছেন। সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে রোড সেফটি। গত ২৩ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে মোটর সাইকেল। ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৪ জন। যা মোট নিহতের ৪২.৬৭ শতাংশ। দুর্ঘটনার হার ৫০.৬২ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য ছিল পথচারী নিহতের সংখ্যা। এই ঈদে দুর্ঘটনায় ৭৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৪.২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৩৭ জন, অর্থাৎ ১১.৭৮ শতাংশ।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিবেদনে অবশ্য নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে তিনশ’র কম। সংগঠনের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩১৯ জন।
নৌপথে বাংলাবাজার ফেরিঘাটে ফেরিতে হুড়াহুড়িতে পদদলিত হয়ে ৫ জন নিহত ও শতাধিক অসুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসেবে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা ৪৩১টি।
বর্তমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সি ছেলেরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক; অথচ অনেকে হেলমেটবিহীন, আবার অনেকে দুজন যাত্রীসহ মোটরসাইকেল চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ অর্থাৎ মোট চারজন মোটরসাইকেলে ভ্রমণ করে, এটা খুবই বিপজ্জনক। বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ফিডার রোড থেকে প্রধান সড়কে ওঠার নিয়ম হলো-প্রথমে প্রধান সড়কের গাড়িকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তারপর ডানে-বামে দেখে ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে হর্ন বাজিয়ে প্রধান সড়কে উঠতে হবে। মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের মোটরসাইকেলের পরিবর্তে বাইসাইকেল চালনায় উৎসাহিত করতে হবে।
সড়ক-মহাসড়কে বেঘোরে মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের কাছে সারাজীবনের জন্য গভীর ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে জারি রয়েছে, বেরও হয়েছে অনেক কিছু। তবু বছর বছর দুর্ঘটনা নতুনরূপে হাজির হচ্ছে, এটা কাম্য নয়। এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের দ্রুত সক্রিয়তা জরুরি।
লক্ষ্যণীয় জাতিসংঘের যেসব সদস্য রাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল তার একটি বাংলাদেশ। অঙ্গীকার পূরণ দূরে থাক, বরং যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এটা শুধু ফাঁপা অঙ্গীকার ছিল। দুর্ঘটনা রোধে বা কমিয়ে আনতে সত্যিকার অর্থে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো আদৌ কোনো কার্যকর পরিকল্পনা ও কৌশলই গ্রহণ করেনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্বহীনতার আরেকটি বড় প্রমাণ। আমাদের দেশে কী কী কারণে এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব-সেসব বহুল আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মোটা দাগে কিছু কারণ বিদ্যমান। এগুলো হলো, চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা, ফিটনেসবিহীন ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ইত্যাদি।
সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোয় বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দেশের সড়ক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো সংশোধন করতে হবে। এছাড়া রাস্তার পাশে হাটবাজার স্থাপন ও ওভারব্রীজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সঠিক প্রকৌশলগত জ্ঞানের ভিত্তিতে এসব ত্রুটি দূর করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।