অনলাইন জুয়ার বিস্তার

প্রযুক্তি ও অর্থ লেনদেনের সহজলভ্যতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জুয়াড়িরা জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ১২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

প্রযুক্তি আর অর্থ লেনদেনের সহজলভ্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিস্তার লাভ করেছে অনলাইন জুয়া। জুয়াড়িদের অভিনব কৌশল তদন্ত সংস্থাগুলোকে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল আলম বলেছেন, অনলাইন জুয়াড়িরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নানা কৌশল এঁটেছে। তারা অপ্রচলিত অ্যাপসভিত্তিক যোগাযোগ করে। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামে তারা এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করে। যারা জুয়া খেলে তারাও এসব অ্যাপ ও নম্বর ব্যবহার করছে। প্রতিনিয়তই তাদের নম্বরগুলো বদলে ফেলছে। তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করলে গ্রুপের সমস্ত তথ্য ডিলিট করে দেওয়া হয়। এছাড়া ছদ্মনামে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগ করে, ফলে কেউ কাউকে চেনে না। এতে গ্রেপ্তারকৃতের কাছ থেকেও আশানুরূপ তথ্য পাওয়া যায় না।

নিষিদ্ধ অ্যাপ স্ট্রিমকার ব্যবহৃত হচ্ছে : অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইন জুয়া পরিচালনা হচ্ছে দেশবিদেশের বিভিন্ন সাইট থেকে। ফেসবুকইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে এসব সাইটের বিজ্ঞাপন। তেমনই একটি অ্যাপ স্ট্রিমকার। ব্যবহারকারীরা সাধারণত সুন্দরী মেয়ে ও সেলিব্রিটিদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন। স্ট্রিমকার অ্যাপে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীদের লাইভে এনে পাতা হচ্ছে ফাঁদ। অনেকে সেই ফাঁদে পা দিয়ে অনলাইন কারেন্সি কিনে তা উপহার দেন তরুণীদের। পরে স্ট্রিমকার অ্যাডমিনদের কাছ থেকে এই কারেন্সি কিনে তা চ্যাটকারীদের কাছে বিক্রি করে প্রতারকচক্র। পুলিশ বলছে, এই প্রক্রিয়ায় প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে শতকোটি টাকা। সুন্দরী মেয়ে ও সেলিব্রেটিরা হোস্ট এজেন্সি নামক একটি প্রতারকচক্রের মাধ্যমে প্রথমে এই অ্যাপের হোস্ট আইডি খোলে। তারপর এ তরুণীদের সঙ্গে যারা আড্ডা দিতে আসে তাদের হোস্ট এজেন্সির কাছ থেকে বিন্স নামক এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি বা মুদ্রা কিনে তা সুন্দরীদের গিফট করতে হয়। লাইভে থাকার জন্য সুন্দরী মেয়েদের প্রতি মাসে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন।

মাসে শত কোটি টাকা পাচার : বাংলাদেশে স্ট্রিমকার ব্যবহার করা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এগুলো তারা ব্যবহার করছে। স্ট্রিমকার অ্যাডমিন প্যানেল থেকে এই মুদ্রা ক্রয় করে তা ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে হোস্ট এজেন্সি। পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে এ ধরনের ১২ থেকে ১৫ জন এজেন্ট রয়েছে যারা প্রতি মাসে প্রায় শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম বলেন, দেশের কিছু সুন্দরী তরুণী নিজের অবস্থান থেকে নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে মাসিক বেতনে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশের সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে আছে।

দুই শতাধিক অনলাইন অ্যাপে চলে খেলা : গোটা দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ এখন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। তিন পাত্তি, লাইভ ক্যাসিনো, ক্রিকেট, ফুটবলসহ দুই শতাধিক মুঠোফোন অ্যাপে জুয়া খেলা হয়। পুরো ব্যাংকিং প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে ডলারের মাধ্যমে জুয়ার যাবতীয় লেনদেন করা হয়। হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকা চলে যায় দেশের বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রেকর্ডে প্রতি সপ্তাহেই অনলাইন জুয়ায় আসক্তদের অপরাধের তথ্য রয়েছে। যা প্রায় গত এক বছরে ক্রমশই বেড়ে চলেছে। মূলত এতে আসক্ত ভুক্তভোগীরা দিনদিন সহিংসপ্রবণ হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি জুয়ার সাইট রাশিয়ান মোস্টবেট : সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে একটি মামলার তদন্ত চলছে। তাদের তদন্তে পাওয়া কিছু মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের লেনদেন পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ডিএফআইইউ)। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ মাসের লেনদেনে দেখা যায় প্রতিটি এমএফএস একাউন্টে মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী নমুনায় থাকা ৫টি নম্বরে ৬ মাসে নেওয়া হয়েছে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা প্রতিমুহূর্তে নম্বরগুলো বদলে ফেলতো। তদন্ত শুরু করার পর আমরা সব নম্বর উদ্ধার করতে পারিনি। তবে ধারণা করা যাচ্ছে এভাবে শত কোটি টাকা একটি সাইটের মাধ্যমেই নেওয়া হয়েছে।

এসব অর্থ অবৈধ ভার্চুয়াল কারেন্সি হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে টাকাগুলো কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচার হয়েছে ।

কয়েকশ জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে বিটিআরসি : বিটিআরসি বলেছে, মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেম বা জুয়ায় অংশগ্রহণ করে। এভাবে অপরাধী চক্র দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। এর মধ্যে কয়েকশ জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে। গুগল প্লেস্টোর, ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে জুয়া সংক্রান্ত কয়েকশ অ্যাপ ও লিংক বন্ধে রিপোর্টও করা হয়েছে। এর আগে বিটিআরসিকে অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন, বিশেষ করে স্পোর্টস চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইনে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ব্যাংককে সব মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী, যেগুলো সব বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদানপ্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয় তাদের গেটওয়ে এবং চ্যানেলগুলো বন্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

ক্যাসিনোর পরিবর্তে অনলাইন জুয়া : দেশে সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছিল। পুরোপুরি অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করে। এরপরই মূলত ধীরে ধীরে অনলাইনে বিস্তার হতে শুরু করে জুয়ার সাইটগুলো। যা ২০২০ সালে বেশকিছু অভিযানে গ্রেপ্তারের পর স্পষ্ট হয়। তবে ওই সময় থেকেই ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পর খুব দ্রুতই তারা জামিনে বেরিয়ে পরে। এরপর তারা আবার গড়ে তুলে জুয়ার সাইট।

২০২১ সালে কয়েকটি জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। এ ছাড়াও মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার শাখাসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। এ সময় দেশে অনলাইন জুয়া অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সিআইডির অভিযানের পর মোস্টবেটের তৎপরতা থেমে যায়। অন্যদিকে সিআইডির তদন্ত কার্যক্রমও অনেকটা থেমে যায়, যা এখনও তেমন গতি পায়নি। ফলে ধীরে ধীরে আবারও সক্রিয় হয়েছে সেসব জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানগুলো।

জুয়া আইন, ২০২৩’এর খসড়া : জুয়া আইন, ২০২৩’এর খসড়া করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। যে আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগে জুয়ার প্রভাব অনেকাংশে কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে যেসব জুয়ার প্রচলন আছে তার বেশিরভাগ এজেন্টই দেশের বাইরে বসে জুয়ার সাইট পরিচালনা করায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কীভাবে বাইরের দেশের সহযোগিতা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার উদ্যোগও ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাতামুহুরী নদীতে ড্রেজিং ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে পানির নিচে ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসল