অনলাইনে ভোগান্তির শেষ নেই

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৩ জুন, ২০২২ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

পাসপোর্ট, অনলাইন জন্মনিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি ও সংশোধন নিয়ে মানুষের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি দলিল তৈরি এবং সংশোধনে শহরে-গ্রামে হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। দিনের পর দিন ঘুরেও জুটছে না অনলাইন জন্মনিবন্ধন। আবার অনলাইন জন্মনিবন্ধন ছাড়া জুটছে না জাতীয় পরিচয়পত্র। এই দুটি ঠিকভাবে পেলেও মিলছে না পাসপোর্টের মতো জরুরি জিনিস।
এদিকে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে আগে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে মা-বাবাকে। হাজার হাজার মানুষের জন্মনিবন্ধনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সার্ভার। সার্ভারে প্রায়শ সমস্যা হচ্ছে। এতে করে দিনে দিনে অনলাইন জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট অনেকের কাছে সোনার হরিণ হয়ে উঠছে।
মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনের বাড়ি সীতাকুণ্ডের বড় দারোগারহাটে। এক সপ্তাহ ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও অনলাইন জন্মনিবন্ধন করতে পারেননি নিজের ইউনিয়ন পরিষদে। একজন বুদ্ধি দিয়েছে শহরের কোনো কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করিয়ে নিলে তার কাজ সারবে। এজন্য শহরে এসে দফায় দফায় ধর্ণা দিয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে। নানাভাবে চেষ্টা করেও অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সম্ভব হয়নি। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন না হলে তার পাসপোর্ট হবে না। পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে অনলাইন জন্মনিবন্ধন কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। আবার জাতীয় পরিচয়পত্র করাতে হলেও লাগবে অনলাইন জন্মনিবন্ধন। অর্থাৎ জন্মনিবন্ধন ছাড়া কোনোভাবে তার পাসপোর্ট করার সুযোগ নেই। খুলশীর ইমতিয়াজ সালেহ পড়ে দশম শ্রেণীতে। তার পাসপোর্ট লাগবে। কিন্তু বয়স না হওয়ায় পরিচয়পত্র পায়নি। ভরসা অনলাইন জন্মনিবন্ধন। কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে জেনেছে, তার জন্মনিবন্ধনের আগে তার বাবা- মার অনলাইন জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। নিজেরটাই হচ্ছে না, সেখানে আবার বাবা-মা। হতাশ হয়ে ফিরে আসে ইমতিয়াজ।
শুধু উপরোক্ত দুজন নয়, এভাবে হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তি। জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টের মতো স্পর্শকাতর জিনিসের সাথে অনলাইন জন্মনিবন্ধন থাকার ব্যাপারটি সাধারণ মানুষের কাছে ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, হাজার হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করার ঘটনায় সজাগ হয় প্রশাসন। এই ধরনের অপতৎপরতা ঠেকাতে পাসপোর্টের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হয়। এর জের ধরে অনলাইন জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। অনলাইন জন্মনিবন্ধন জরুরি হলেও দেশের লাখ লাখ মানুষকে এই সুবিধা দেয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে অনলাইন জন্মনিবন্ধন করা হয়। কিন্তু এজন্য পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। একজন মাত্র মানুষ একটি কম্পিউটার নিয়ে অনলাইন জন্মনিবন্ধনের কাজ করেন। অধিকাংশ সময় সার্ভার ডাউন থাকে। একই সাথে শত শত কম্পিউটার থেকে একই সার্ভারে প্রবেশের চেষ্টায় সার্ভার ডাউন হয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা গেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধনের জন্য কোনো লোকবল পদায়ন করা হয়নি। ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড অফিসের সচিবকেই স্বাভাবিক কার্যক্রমের বাইরে জন্মনিবন্ধনের কাজ করতে হয়। এতে করে অনেক সময় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থেকেও একজন মানুষ জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না।
শিশুর জন্মনিবন্ধনের জন্য শুরুতে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারটি পরিস্থিতি জটিল করেছে। এখন একজন শিশুর জন্মনিবন্ধন মানে তিনটি জন্মনিবন্ধন। সবগুলোই করতে হয় অনলাইনে। অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের ব্যাপারটি কোনোরকমে সম্পন্ন করা হলে ছুটতে হয় জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য। এটিও অনলাইনে। ফরম পূরণ করতে হয় বিভিন্ন দোকানে। ওখান থেকে প্রিন্ট নিয়ে ছুটতে হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা ইউপি কার্যালয়ে। ওখান থেকে আনুষ্ঠানিকতা সেরে যেতে হয় সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে। সেখানে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও পাওয়া যায় না পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্র সংশোধনের ঝামেলা আরো বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধু আবেদন করে পরিচয়পত্র সংশোধন হয় না। দিনের পর দিন ধর্ণা দিতে হয়। মাসের পর মাস ঘুরেও পরিচয়পত্র সংশোধন না হওয়ার হাজার হাজার রেকর্ড রয়েছে।
পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয় অনলাইনে। কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করে তা সংগ্রহ করার পর পাসপোর্ট অফিসে জমা দেয়ার সময় নতুন ঝামেলা। সার্ভার ডাউন হলে কাজ হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টের আবেদন জমা দেয়া সম্ভব হয় না।
অপরদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে পাসপোর্টের আবেদনের নামে বা ঠিকানায় ছোটখাটো অমিল থাকলেও ছুটতে হচ্ছে আদালতে। এফিডেভিট করতে হচ্ছে। সেখানেও বিশেষ কিছু কথা যুক্ত করতে হয়। নির্দিষ্ট করে দেয়া কথাগুলো যুক্ত না করে এফিডেভিট করলে তা পাসপোর্ট অফিস গ্রহণ করে না। নতুন করে এফিডেভিট করতে হয়। এভাবে অনলাইন জন্মনিবন্ধন থেকে পাসপোর্ট বা আদালতের এফিডেভিট পর্যন্ত কাজ করতে শত শত মানুষকে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে।
একজন নাগরিকের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পাওয়া মৌলিক অধিকার। অনলাইনে এই তিনটি সেবা দেয়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে বড় অগ্রগতি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা, প্রযুক্তির বিড়ম্বনা এবং কিছু মানুষের কারণে জরুরি তিনটি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো সহজ করার সুযোগ রয়েছে।
শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদ আলম বলেন, অনলাইনে জন্মনিবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা বেকায়দায় আছি। হাজার হাজার মানুষ অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করার আবেদন করেন। কিন্তু আমাদের কম্পিউটার নেই, লোকবল নেই। এতে আমরা মানুষকে প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছি না। কাউন্সিলর অফিসে একজন কম্পিউটার অপারেটরের পক্ষে এত মানুষের চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।
পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রচুর আবেদন। মানুষের চাপ অনেক। কিন্তু সার্ভারের সমস্যার কারণে অনেক সময় আমাদেরকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সবকিছু অনলাইনে হওয়ায় সার্ভারের উপর সারাক্ষণ নির্ভর করতে হয়। কোনো কারণে সার্ভার অচল হলে সব কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যায়। সার্ভার গতিশীল হলে এই সংকট থাকবে না বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধজীবনের স্টিয়ারিং ধরার সময়ই হাতটা হারালেন মারুফ