অনলাইনে নারীর হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

| মঙ্গলবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

 

আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সশরীরে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে যৌন হয়রানি, তেমনি অনলাইনেও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমাজে উদ্বেগ বাড়ছে। দেশে ইন্টারনেট তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আস্থার প্রতীক হলেও অশুভ প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার কারণে অনেক নারীর কাছে তা এক আতঙ্কের নাম। সাইবার জগৎকে নারীদের জন্য আমরা এখনও নিরাপদ করে গড়তে পারিনি। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত হয়রানির ঘটনা ঘটছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশই নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনেফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। দুমাস যেতে না যেতে এর মাত্রা ভয়ংকরভাবে বাড়তে শুরু করেছে। সমপ্রতি অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে। এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ২০২২ সালে করা ওই সমীক্ষা অনুসারে, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী (উত্তরদাতা) বলেছেনতারা অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। গত বছরে যা ছিল ৫০ শতাংশ।

সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২২ সালে নারীদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফরম বিশেষ করে ফেসবুক (৪৭.৬০%), মেসেঞ্জার (৩৫.৩৭%), ইনস্টাগ্রাম (.১১%), ইমো (.০৬%), হোয়াটসঅ্যাপ (.৭৫%) ও ইউটিউবে (.৩১%) হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে। ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী বলেছে, ভিডিও কল, মোবাইল ফোন এবং এসএমএসের মাধ্যমেও তারা হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। এ বছরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ নারী অনলাইনে সহিংসতার মধ্যে ঘৃণ্য ও আপত্তিকর যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য, ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী ইনবক্সে যৌনতাপূর্ণ ছবি প্রদান এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব, ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ নারী বৈষম্যমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেনতাদের নামে অন্য কেউ অনলাইনে নকল আইডি খোলায় তারা হয়রানির শিকার হয়েছে।

সমীক্ষায় বলা হয়, অনলাইন সহিংসতায় নারীদের জীবনে গুরুতর প্রভাব হলো মানসিক আঘাত, হতাশা ও উদ্বেগ (৬৫.০৭%)। দ্বিতীয় প্রভাব হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকা বা মতামত প্রকাশ করায় আস্থা হারানো (৪২.৭৯%)। ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ আত্মমর্যাদা হারিয়েছে।

সমীক্ষায় বলা হয়, অনলাইন সহিংসতা এবং হয়রানির কারণে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা নারীর আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। ১৪ দশমিক ৯১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছে এবং ৮৫ শতাংশেরও বেশি ভুক্তভোগী অভিযোগ না দিয়ে নীরব ছিলেন।

সমীক্ষায় উত্তরদাতারা অনলাইন হয়রানি, অপব্যবহার এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুত শাস্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া অনলাইন ও অফলাইন উভয় মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারপ্রচারণা, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি অভিমত দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যে কোনও নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। ইমেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যেকোনও ধরনের অশালীন চিত্র দেখানো, অশালীন উক্তি করাসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে। সব সরকারিবেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন হয়রানির যথাযথ বিচার হচ্ছে না। শিশুর যৌন হয়রানি বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও প্রযুক্তি আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এই সুযোগে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। অনলাইনঅফলাইনে হয়রানির শিকার হয়ে অনেক শিশুকিশোরীর জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আমরা চাই কোনো শিশুকিশোরী অনলাইন বা অফলাইনে যৌন হয়রানির শিকার না হোক। তাদের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থেই বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। এটি রোধ করা না গেলে সামাজিক শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়বে। এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে