অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বাড়ছে

চুপ থাকা নয়, পুলিশ সাইবার সাপোর্টসহ নানা সংস্থায় অভিযোগ জানানোর পরামর্শ

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ১০ জুন, ২০২৩ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। প্রেমের সম্পর্ক ভাঙা বা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে অনেক নারীর ফেইসবুক আইডি হ্যাক করা হচ্ছে, যৌন নিপীড়নমূলক বার্তা পাঠানো হচ্ছে। অনেকের ছবি বা নাম ব্যবহার করে ভুয়া আইডি তৈরি করে হেনস্তা করা হচ্ছে।

ইন্টারনেট নিয়ে জানাশোনা তুলনামূলক কম থাকা এবং সরল বিশ্বাসের কারণে নারীরা অনলাইনে সহিংসতার সহজ লক্ষ্যে পরিণত হন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, বাস্তবের বাইরের জগতে নারীদের বিচরণ কম। অনেকে অনলাইনে বন্ধু গড়তে নিরাপদ বোধ করেন। সরল বিশ্বাস থেকেও প্রতারণার শিকার হন। আবার নিজের আইডির ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও অনেক নারী কম জানেন। অন্যদিকে নিপীড়ক পুরুষেরা অফলাইন, অর্থাৎ বাস্তব জগতের মতো অনলাইনেও সক্রিয় থাকে। মাসুম নামে এক হ্যাকারকে গ্রেপ্তারের পর নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানতে পেরেছে, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, বিশেষ করে নারীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ‘ফিশিং লিংক’ (কাউকে ধোঁকা দিয়ে হ্যাক করতে অনলাইন মাধ্যমে পাঠানো লিংক) ব্যবহার করতেন তিনি।

সম্প্রতি পর্নোগ্রাফি চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। চট্টগ্রাম ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, হোতা মার্কসাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।

গ্রেপ্তারের পর গত ২২ মে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আইডি হ্যাক কিংবা নারীদের সঙ্গে সখ্য বৃদ্ধি করে তাদের অশালীন ভিডিও ধারণ করতো মার্ক সাকারর্বাগ ওরফে আবু সায়েম। তিনি জানান, পরে সেসব নারীদের ব্ল্যাকমেইল করে টাকা বা আপত্তিকর ভিডিও পাঠানোর প্রস্তাব দিতে তারা। যাতে রাজি না হলে টেলিগ্রামের ৪ লাখের বেশি সদস্য সংবলিত একটি গ্রুপে প্রথমে ট্রেইলার পরে সেসব ভিডিও ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করতো চক্রটি। সিআইডি প্রধান বলেন, এদের একটি একাউন্টে কোটি টাকার বেশি লেনদেনের সন্ধান পেয়েছেন তারা। এখানে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি।

গত ১৬ মার্চ এনজিও কর্মীর সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলিং করে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তার দু’জন একইভাবে অর্ধশতাধিক নারীর সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলিং করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে র‌্যাব জানিয়েছে। র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের উপঅধিনায়ক মেজর মো. রেজোয়ানুর রহমান আজাদীকে জানান, সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসারের মিথ্যা পরিচয়ে জহির পেকুয়ার এক এনজিও কর্মী তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়। তরুণী রাজি না হওয়ায় তাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার জন্য চাপ দেয়, না হলে ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তরুণী টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু দিতে দেরি হওয়ায় ছবি ও ভিডিও জহির তার ঘনিষ্ঠ সরোয়ারের হোয়্যাটস অ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দেয়। সরোয়ার আবার তরুণীকে ফোন করে চাপ দেয়। এরপর ছবি ও ভিডিও তরুণীর চাচাতো ভাইয়ের কাছে পাঠায়। তখন চাচাতো ভাইকে তরুণী ঘটনা খুলে বলার পর তারা র‌্যাবের স্মরণাপন্ন হন।

মেজর রেজোয়ান আরও জানান, গ্রেপ্তার জহির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, একইভাবে প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীর ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও সে ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করেছে।

এ ধরনের ঘটনা একটা নয়, হরহামেশাই ঘটে চলেছে। মেয়েরা অপরাধের স্বীকার হলেও কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না বিভিন্ন কারণে যেমন তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। তারা ভাবে এসব বাবা মা বা অন্য কাউকে জানালে তাকে সবাই খারাপ ভাববে, অথবা ভাবে এসব মানুষ জানলে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েরা এসব বিষয় লুকিয়ে বিপদ থেকে মুক্তি পায় না বরং আরও বেশি বিপদের মধ্যে পড়ে।

মেয়েরা অনলাইনে নানাভাবে অপরাধের স্বীকার হয় যেমন ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া, ফেসবুক আইডি হ্যাক, ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি, ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়, ব্ল্যাকমেইলিং, ছবি বা ভিডিও এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, সুপার ইম্পোজ ছবি, পর্নোগ্রাফি ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনটেন্ট বা ফেক আইডি তৈরি, সাইবার বুলিং, ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, হয়রানিমূলক এসএমএস বা মেইল বা লিংক পাঠানো ইত্যাদি।

সাইবার হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীদের ৮০ ভাগই নারী। অপরাধের শিকার হয়ে একটি বড় অংশই অভিযোগ করেন না। বেশীরভাগ মেয়ের বয়স ১৪ বছর থেকে ২২ বছর। প্রেমিক, বন্ধু, সহপাঠী, প্রতিবেশীসহ নানান ধরনের মানুষ দ্বারা তাদের সাইবার হয়রানি হতে হচ্ছে।

এ অবস্থায় মেয়েদের করণীয় প্রসঙ্গে সিআইডি প্রধান জানান, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ চালু করা হয়েছে মেয়েদের জন্য। সেখানে অভিযোগ দেওয়া যায়। এছাড়া আরও অনেক উপায় আছে। যেমন ৯৯৯এ কল করা এবং নারীদের বিভিন্ন সংস্থা আছে, যারা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। তাদের সহায়তা নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘আঁধার ভেঙে আলোর বুননের’ তিন যুগ
পরবর্তী নিবন্ধতিনটি করে গাছ লাগান, অকারণে কাটবেন না