স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন মানবতার আদর্শের ধারক ও বাহক যেমন তেমনি সমাজ পরিবর্তনের তথা উন্নয়নের ধারক ও বাহক। চলমান সমাজ উন্নয়নে উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং গভীর দেশপ্রেমকে। তার বহুমাত্রিক কর্ম প্রতিভা কীর্তির মহাকাব্যিক অনুষঙ্গ হয়ে জীবনের প্রবহমান ধারার সাথে একাত্ম হবার প্রয়াস পেয়েছে। তিনি তার মেধা মনন, চেতনাবোধ, দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা এবং প্রগাঢ় ত্যাজদীপ্ত মনোভাবে পবিত্র এক সাধনার মতো এই চট্টগ্রাম শহরের সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতকে আলোকিত করেছেন। মহাত্মা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এক দিগন্ত বিস্তৃত চলমান আদর্শের নাম। তিনি একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
১. বাল্যকাল থেকে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী চরিত্রের মানুষ, পরোপকারী এবং ধর্মীয় চেতনাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।
২. লেখাপড়ায় ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের স্কুলে শৈশব থেকে বঙ্গীয় বৃত্তি পেয়েছেন ২য় ও ৫ম শ্রেণিতে। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে রাউজান আর আর সি ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে পাস করে চট্টগ্রাম জেলা বৃত্তি অর্জন করেন। অতঃপর ধাপে ধাপে অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞায় একজন প্রকৌশলী হয়ে উঠেন এবং তিনি চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
৩. কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল সৃজনশীল ভাবনা এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রয়াস। ত্যাগী, সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হয়েও চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও লাইব্রেরি। দুটো বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত মেধা ও মননের বিকাশের অন্যতম উপাদান। আর কোহিনূর নামকরণ ছিল মুসলমানের শৌর্য বীর্যের প্রতীক মহামূল্যবান হীরকখণ্ডের মুকুট যা মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক।
৪. গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি মানে জ্ঞানের উৎস। দেশের নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করার লক্ষ্যে তিনি মহৎ কাজে ব্রতী হন। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা মানে বই তথা জ্ঞানের উৎসের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করা অর্থাৎ পশ্চাদপদ এই জেলার মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা।
৫. তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল দানশীলতা গরীব দুঃখীদের প্রতি মানবিক টানে তাদের কল্যাণে বা তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার লক্ষ্যে তাঁর চিন্তাভাবনাও ছিল অনন্য সাধারণ।
৫. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় দৈনিক পত্রিকা আজাদী প্রতিষ্ঠা করা ছিল প্রকাশনা জগতের এক মাইলফলক এটি প্রকাশের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটান।
৬. পেশাগতভাবে একজন প্রকৌশলী হলেও তিনি একজন সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে ডিসেম্বর তাঁর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক কোহিনূর। গভীর পর্যবেক্ষণে উপলব্ধি করি পঞ্চাশের দশকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনায় একজন বিপ্লবী নারীকে দায়িত্ব দেন। তিনি চট্টগ্রামের পাঠানটুলীর একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সৈনিক লোকমান খান শেরওয়ানীর জীবনসঙ্গী শবনম খানম শেরওয়ানীকে। এমন কি তাঁকে সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্বও দেন। এভাবে নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রদূত ছিলেন তিনি।
এই সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের কারণে অনেক বিদুষী নারীর জন্য এই পত্রিকায় তাদের সৃজনশীল চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পত্রিকা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা দাবিকারকদের বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার। একুশের প্রথম কবিতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’ প্রকাশের কারণে খড়গ নেমে এসেছিল এই পত্রিকার ম্যানেজার দবির আহম্মদ চৌধুরী ও প্রেস কর্মচারীদের ওপর।
৭. ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ই সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। আর পত্রিকার হকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কিছু ভিক্ষুককে যাতে তাঁরা আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। এটি ছিল তার এক অনন্যসাধারণ কৌশল যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
সেদিনের দৈনিক আজাদী এখন চট্টগ্রামের মানুষের অদ্বিতীয় মুখপাত্র। লালন ধারণ করে চলেছে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে।
এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত আউলিয়া আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ (র.) এর প্রথম খলিফা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সৎ ও ধর্মপ্রাণ। মানবতার প্রতি মহানুভবতা ছিল তাঁর আদর্শ। তিনি শুধু প্রকৌশলী বা সম্পাদক ছিলেন না, ছিলেন এক কৃতী সমাজ সংস্কারক এবং দেশের প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের অনুপম আদর্শ ও চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুন্দর দেশ ও সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে। যে পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ ও মানবতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে তিনি প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন তা নতুন প্রজন্মের মাঝে সঞ্চায়িত হোক এই প্রত্যয় রেখে এই মহাত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তথ্যসূত্র : মহাত্মা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, সাখাওয়াত হোসেন মজনু, মর্জিনা আখতার
লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক, সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।