
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যদি শুধুমাত্র একটি সশস্ত্র বিজয়ের ইতিহাস হিসেবে দেখা হয়, তবে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল নৈতিক অভ্যুত্থান ও সমন্বিত অধিকার আদায়ের প্রতিরোধ। অস্ত্রের পাশাপাশি কলম, চিন্তা, বিবেক, আদর্শ, চেতনা ও শিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ একটি অনিবার্য নাম। তিনি কেবল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি গভীর রাষ্ট্রচিন্তা ও নৈতিক রাজনীতির প্রতীক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি, নৈতিকতা এবং নাগরিক দায়বদ্ধতার মধ্যে তিনি নিজেকে প্রজ্ঞাবান প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
অধ্যাপক খালেদ মুক্তিযুদ্ধকে এককালীন ঘটনা হিসেবে দেখেননি। এটিকে চলমান রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবিক প্রক্রিয়া হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে শুধুমাত্র ভৌগোলিক মুক্তি নয়। এটি ছিল চিন্তার স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অস্প্রদায়িকতা এবং মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার স্থায়ী রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। পাকিস্তানি শাসনের রাজনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক দমন ও বাঙালির অস্তিত্ব সংকটের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সচেতন ও আদর্শনিষ্ঠ ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরামর্শক এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রমাণ করে, তিনি রাষ্ট্র গঠনের কাঠামোগত ভিত্তি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাশীল ছিলেন।
অধ্যাপক খালেদ ১৯২২ সালের ৬ জুলাই পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কর্মসূত্রে শৈশবের কিছু সময় তিনি বিহারে কাটালেও পৈতৃক নিবাস ছিল চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। শৈশব থেকেই তিনি বর্ণাঢ্য জীবনবোধ ও সামাজিক সচেতনতার পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন। কলেজ জীবনেই তিনি ভারত বিভাজন আন্দোলনে যুক্ত হন, যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা নির্দেশ করে। ১৯৪২ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বিএ তে ভর্তি হন।
পিতার অকাল মৃত্যুর পর পারিবারিক শূন্যতা ও আর্থিক সংকটের কারণে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর নানা পেশায় যুক্ত হলেও শিক্ষার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে কলকাতায় ফেরায়। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আজিজুল হকের পরামর্শে তিনি ইসলামের ইতিহাসে এমএ ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে মামা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ছিলেন।
তিনি রাজনৈতিক জীবনে দলীয় সীমার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর দর্শনে রাজনীতি হলো দায়িত্ব পালন, রাষ্ট্র হলো সেবা, আর মুক্তিযুদ্ধ হলো চলমান নৈতিক সংগ্রাম। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা, দুর্নীতি বা গণতান্ত্রিক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে গঠনমূলক সমালোচনা করা তাঁর নৈতিক দায়িত্বের অংশ ছিল। তিনি মানুষের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন।
শিক্ষা, সাংবাদিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রেই অধ্যাপক খালেদের দর্শন একই। নৈতিক দায়িত্ব ও বিবেক সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতেন। শিক্ষাকে তিনি ইতিহাস, রাজনীতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে বিবেক গঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন সব সময়। সাংবাদিকতাকেও তিনি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সত্যের প্রতি অনুগত কলমের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন, গণমাধ্যমের বিবেক হারালে রাষ্ট্রও পথ হারায়। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের আয়না মনে করতেন।
মুক্তিযুদ্ধকে তিনি শুধু ভূখণ্ডের মুক্তি হিসেবে দেখতেন না। এটি ছিল নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম, চিন্তার স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। তাঁর মানবিক, দেশপ্রেম, জীবন আমাদের শিখায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া মানে কেবল অতীতের গৌরব বহন নয়। বরং বর্তমানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, স্বাধীনতাকে নৈতিক ও মানবিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা। তিনি ইতিহাসের নামমাত্র চরিত্র নন। একটি নৈতিক মানদণ্ড, যার আলোয় রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত অবস্থান যাচাই করতে হয়। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ রাখা অর্জনের চেয়ে অনেক কঠিন। যা আমাদের সবার জীবনে স্মরণের নয়, অনুশীলনের বিষয়, আনুগত্যের বিষয়ও।
তিনি ছিলেন নৈতিক আদর্শ ও বহুমুখী কর্মজীবনের প্রতিচ্ছবি। ব্যবসা, বাণিজ্য, ব্যাংকিং, শিক্ষকতা, যেকোনো ক্ষেত্রেই তিনি আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাননি। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল সততা, নৈতিকতা ও মানবিক দায়িত্ববোধ। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ব্যাংক চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় ফিরে আসা এবং নাজিরহাট কলেজে শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিনি শিক্ষাকে সামাজিক দায়িত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেন। সাংবাদিকতায় তিনি নিজেকে অকুতোভয় কলমযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং দৈনিক আজাদীর সম্পাদক হিসেবে সংবাদপত্রকে সত্যের প্রতি অনুগত রেখে নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। আজ এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও এই পত্রিকা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সত্যের কণ্ঠ হয়ে।
রাজনৈতিকভাবে তিনি দলীয় অন্ধত্বের ঊর্ধ্বে থেকে গঠনমূলক সমালোচনার প্রতীক ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া তাঁর নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের প্রমাণ। সংবিধান প্রণয়নে তাঁর অবদানও স্মরণীয়। প্রথম জাতীয় সংসদে এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার কণ্ঠ হিসেবে দেশের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া কেবল অস্ত্রের জয় নয়। এটি নৈতিক দায়িত্ব, বিবেক এবং মানবিক রাজনীতির উচ্চমাত্রায় দাঁড়ানো। তিনি দেখিয়েছেন, স্বাধীনতা কেবল অর্জনের বিষয় নয়, বরং তা অর্থবহ ও টেকসই রাখতে হলে সাহস, সততা ও ন্যায়বিচারের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হয়। শিক্ষকের প্যাড, সাংবাদিকতার কলম, রাজনীতির মঞ্চ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন, সব ক্ষেত্রেই তাঁর দর্শন একই। দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রের সেবা। আজকের সংকটময় পরিস্থিতি, বাংলাদেশে তাঁর মতো মুক্ত কণ্ঠের প্রয়োজনতা অনুভব করছি। তাদের প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম আজকের বাংলাদেশকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল।
তাঁর জীবন আমাদের শিখায়, যে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার রক্ষা করার জন্য প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। অধ্যাপক খালেদ শুধুমাত্র ইতিহাসের চরিত্র নন। তিনি একটি নৈতিক মানদণ্ড, যার আলোয় রাষ্ট্র, আলোকিত হয়ে রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত অবস্থান যাচাই করতে হবে। তাঁর জীবন অনুশীলনের বিষয়, স্মরণের নয়, এবং এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
লেখক : কবি–প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক












