দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অগ্রগণ্য অভিভাবক–রাজনীতিক ও সৎ–সততার জ্ঞানাঙ্কুর পথিকৃৎ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে নিজেকে উন্নীত করার এক জ্ঞানস্ফীত পাঠশালা দৈনিক আজাদীর সম্পাদক প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ত্রৈকালিক অভিযাত্রায় প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহের সমন্বয় ঘটিয়ে রচনা করেছেন জীবন–দর্শনের তৌর্যত্রিক পান্ডুলিপি। উপমহাদেশের ইতিহাসে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবি–শিক্ষাবিদ–রাজনীতিবিদ–সাংবাদিক–সুশীল ও সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করার মোহময় শক্তিময়তায় ঋদ্ধ মোহাম্মদ খালেদ পূর্ণাঙ্গ সার্থক হয়েছিলেন স্বকীয় সত্তার নিগূঢ় অবগাহনে। অনুপম অনুপ্রেরণা ও তেজোদীপ্ত মহিমায় আত্মপ্রত্যয়ী–আত্মসংযমী–আত্মত্যাগী হওয়ার অপার সম্ভাবনার দ্বার–উন্মোচক সকলের সর্বাধিক জনপ্রিয় চট্টগ্রামের বিবেকখ্যাত এই মহান পুরুষ। মনুষ্যত্ব–মানবিকতা বিকাশে, পরার্থে মাঙ্গলিক জীবনচরিত নির্মাণে প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রসারমান ঋদ্ধতায় অনবদ্য কৃতি মানসের স্বরূপ উম্মোচন করেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। শুধু পরিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন নয়; আদর্শিক চেতনায় জ্ঞানসৃজন ও বিতরণে সামাজিক অসঙ্গতি পরাভূত করার লক্ষ্যে তাঁর সকল কর্মযজ্ঞই ছিল জ্ঞাপিত।
চট্টগ্রামস্থ রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রাম আদি আবাসভূমি হলেও; ১৯২২ সালে ৬ জুলাই খ্যাতিমান উচ্চপদস্থ পিতার চাকুরির সুবাদে অবিভক্ত ভারতের বিহার প্রদেশের রাজধানি পাটনাতে তাঁর জন্ম। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা প্রাপ্তির অভিযাত্রায় তাঁর অনন্য অবদান ছিল বিপুল সমাদৃত। এই মানবী উড্ডীনকে জাগরুক রাখার জন্যই হয়তো ধরিত্রীর চিরন্তন বিধি অনুসরণে ২০০৩ সালে বিজয় মাসের ২১ তারিখ শেষ গন্তব্যের ঠিকানা না ফেরার দেশে ফিরে গেছেন। দেশমাতৃকার মুক্তির বিজয় মাসে তাঁর পরলোকগমন করুণ প্রয়াণ দিবসকে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। আপামর জনগণের মাঝে নিরন্তর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অমর গৌরবগাঁথায় সাজিয়েছেন যেন অপূর্ব জীবনোদ্যান। বিহার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা পিতার কর্মজীবনের সারথি হয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য শিশু–কিশোর জীবন অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে স্থায়ী ভিটেবাড়িতে ফিরে এসে নৈসর্গিক এক পরিবেশে বাল্যজীবনের সুখবোধকে জাগ্রত করেছেন।
১৯৪০ সালে মেট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অত্যুজ্জ্বল অবস্থান ধারণ করেন। কলেজ জীবনের পদচারণায় তিনি ভারত বিভাগ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে তাঁর ত্যাগপাঠ শুরু করেন। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সাথে আইএ পাস করে ঢাকা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার আগ্রহ থাকলেও ‘হিন্দু–মুসলমান দাঙ্গা’ ও ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’ ইত্যাদির কারণে সেখানে ভর্তি হতে না পেরে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানেই তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বরেণ্য রাজনীতিকের সান্নিধ্যে আসেন। পিতার মৃত্যুজনিত পারিবারিক শূণ্যতায় চট্টগ্রামে ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজে পুনরায় ভর্তি হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিছুটা নাজুক হয়ে পড়লে অর্থোপার্জনে নানামুখী কর্মে যুক্ত হন। পুনরায় কলকাতায় গিয়ে অর্থনীতিতে এমএ পড়ার ইচ্ছার অবদমন ঘটিয়ে তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলার স্যার আজিজুল হকের পরামর্শক্রমে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে এমএ পাস করেন।
উল্লেখযোগ্য যে, কলকাতায় এমএ পড়াকালীন আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন তাঁর শ্রদ্ধেয় মামা দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ও কর্মজীবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট হন। দিয়াশলাই–ফাউনটেন পেন বিক্রির ব্যবসা, ‘ফ্রেন্ডস ষ্টোর’ নামে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর প্রতিষ্ঠা–বাঁশ ও বেতের ফার্নিচারের ব্যবসা, ক্লিয়ারিং–ফরওয়ার্ডিং ব্যবসায় মনোনিবেশ করেও পরিপূর্ণ আত্মসন্তুষ্টি পূরণে ব্যর্থ হন। পরবর্তী পর্যায়ে কিছু দিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন–রাউজান স্কুলের শিক্ষকতা এবং সর্বোপরি দীর্ঘ সময় নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা করে জীবনযুদ্ধে ত্রৈরাশিক তপস্যায় নিয়োজিত হন। আন্দরকিল্লা টাউন কো–অপারেটিভ ব্যাংক এবং পরে গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকে চাকুরি চলাকালে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েন। আবারও ব্যাংকে যোগদান করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়ের সাথে আপস করার কলুষতাকে পরিহার করে ১৯৫৫ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসেন।
জীবনের নির্মম বাস্তবতায় বারবার কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আদর্শ থেকে ন্যূনতম বিচ্যুত না হয়ে সকল ক্ষেত্রে সৎ–সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পরিচয়–পরিধি সমৃদ্ধ করেছেন। নানা কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত হয়েও নীতি–নৈতিকতার সাথে সৎ জীবন যাপনের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এরই মধ্যে তাঁর জীবনাদর্শ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের প্রস্তাবে কোহিনূর প্রেস ও সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘কোহিনূর’ প্রকাশে নিজেকে সমর্পণ করেন। বাংলাদেশের অতি উচুমার্গের কৃতিমানব, নির্লোভ ও নির্মোহ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। তিনি অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষায় অগ্রবর্তী হওয়া এবং কুসংস্কারমুক্ত অবাধ ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা–চেতনার আচ্ছাদনে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সাল ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সুষ্ঠু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ একজন অকুতোভয় কলমযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ধারাবাহিকতায় আদর্শ–তীর্থ মামা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এর দ্বিতীয় মেয়ে বা মামাতো বোনকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক অধ্যাপক খালেদের মধ্যে নিখাঁদ গুণাবলীর প্রতিফলন দেখতে পান।
পত্রিকা প্রকাশের দুই বৎসর পর ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর এই মহান প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক পরলোকগমন করলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিনি ২০০৩ সাল পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। গণমাধ্যম জগতে উজ্জ্বল তারকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অধ্যাপক খালেদকে রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক সমৃদ্ধির উঁচুমার্গে পৌঁছে দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে তিনি ১৯৪৪ সালে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তান বিরোধী প্রায় প্রতিটি আন্দোলন–সংগ্রামে নিবিড় ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১২ হাজার ৮৬ ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করেন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তখনকার চট্টগ্রাম–৬ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ত্রিশলক্ষ শহীদান ও দুই লক্ষ জননী–জায়া–কন্যার সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি–রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাক্কালে হোটেল পূর্বাণীতে সংবিধান প্রণয়নের কার্য পরিকল্পনায় তিনি যুক্ত ছিলেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ৩২ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ সংবিধান কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার স্টুডিও স্থাপনের পর থেকে দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন অন্যতম পূর্ণকালীন পরামর্শক ছিলেন।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক খালেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব তাঁর এই অবদানের জন্য ২০১১ সাল থেকে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রবর্তন করে। প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে নির্ধারিত বিষয়ে এই বক্তৃতা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে তাঁকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)’ প্রদান করা হয়। সাহিত্য–সংস্কৃতি–ইতিহাস–ঐতিহ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’র উদ্যোগে প্রতিবছর তাঁর নামে প্রবর্তিত ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ অনুষ্ঠান অব্যাহত আছে। খালেদ স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে যে কোন ব্যক্তিকে হাসিমুখ ও অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বরণ করার বিষয়টি সর্বত্রই সমাদৃত। তাঁর সান্নিধ্যে আনন্দঘন আলাপচারিতার দৃশ্যপট অপরিমেয় অনুপ্রেরণা–প্রেষণার উপাদানরূপে এখনো স্মৃতি জাগানিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে কোন শিক্ষককে ‘স্যার’ সম্বোধন ও কথোপকথনে তাঁর অমায়িক এবং হৃদয়গ্রাহী বাচনিক ভঙ্গি সবাইকে বিমুগ্ধ করে রাখত। আজকের এই প্রয়াণ দিবসে পরম শ্রদ্ধেয় স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। পূত–পবিত্র, ন্যায়–সত্যনিষ্ঠ এই মহান অবিস্মৃত কৃতাভিষেক রচয়িতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ দেশবাসীর হৃদয়ে চির জাগরুক থাকুক। তাঁর আদর্শ ও নীতি– নৈতিকতার সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশপ্রেমিক– মেধাবী– যোগ্য তরুণদের জীবনের পাথেয় হোক। মহান স্রষ্টার দরবারে তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের প্রার্থনা করছি।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী