অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন শতাব্দীর অবিস্মরণীয় সম্পাদক। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক। তিনি সাধারণ মানুষ হয়েও মানবসমাজের কল্যাণে অসাধারণ কাজ করে গেছেন। তাঁর মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা তাঁকে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন মৌলিক সাংবাদিক ও আলোকবর্তিকা। তিনি কেবল পত্রিকাকে লিড দেননি সমাজকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। প্রফেসর খালেদ সংবিধান রচনার অন্যতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা হিসেবে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে তিনি চট্টগ্রামের অভিভাবকে পরিণত হন। তাঁর আদর্শ ও নৈতিকতা প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
চট্টগ্রাম একাডেমির সহযোগিতায় শৈলী প্রকাশন আয়োজিত দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে নিয়ে ‘সাংবাদিকতা ও মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক খালেদ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পর্বে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন সাংবাদিক–বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক। সূচনা বক্তব্য দেন শৈলী প্রকাশনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক রাশেদ রউফ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাচিকশিল্পী আয়েশা হক শিমু।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এটি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাদের সমাজে অনুকরণীয় ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তা–চেতনায় ছিল আলোকিত সমাজ গড়ে তোলা। তিনি আমৃত্যু দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দৈনিক আজাদী হাতে নিলেই মনে হয় একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা। এটি তিনি নিজের হাতেই গড়ে তুলেছেন। তিনি আরো বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কাছে আমি অসম্ভব ঋণী। আমার ছাত্র রাজনীতিতে তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি নতুন প্রজন্মকে খালেদের মতো বরণীয় মানুষের আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ
করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, চিরন্তন চট্টগ্রামে অধ্যাপক খালেদ, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও দৈনিক আজাদীকে নিয়ে জেলা পরিষদ ভবনে আলাদা আলাদা কর্নার স্থাপন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কবর পাকাকরণ ও তাঁর নামে সড়ক নামকরণের ঘোষণা দেন।
উদ্বোধকের বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা–সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, দৈনিক আজাদীকে উচ্চ মানে ও উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। আজাদী চট্টগ্রামের হলেও এটি জাতীয় মানের পত্রিকা। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে অনেক সম্পাদক জন্ম নিয়েছেন। এর মধ্যে আজাদী সম্পাদনা করে তিনি শতাব্দীর সম্পাদক হিসেবে পরিগণিত হন।
সভাপতির বক্তব্যে ওয়াহিদ মালেক বলেন, চট্টগ্রামের কথা বলার জন্য আমার দাদা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে চট্টগ্রামের ইতিহাস–ঐতিহ্য লালন করে যাচ্ছে দৈনিক আজাদী। তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রফেসর খালেদ আমাদের জন্য আদর্শ রেখে গেছেন। তাদের আদর্শ অনুসরণ করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
বিকেল সাড়ে ৫টায় জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়বের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ‘রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক খালেদ’ শীর্ষক আলোচনা। এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক। সূচনা বক্তব্য দেন, ব্যাংকার মোহাম্মদ জোবায়ের।
ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন অবিসংবাদিত রাজনীতিবিদ। তিনি গণপরিষদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আলোচিত ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি সংবাদপত্র জগতেও নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি কথায়–কাজে ছিলেন মহান পুরুষ।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ‘সাংবাদিকতায় অধ্যাপক খালেদ’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আমাদের সময় সম্পাদক অধ্যাপক কবি আবুল মোমেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ানের সভাপতিত্বে আলোচনায় আলোচক ছিলেন প্রথম আলো চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক কবি ওমর কায়সার। সূচনা বক্তব্য রাখেন লেখক নিজামুল ইসলাম সরফী।
কবি–সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, সংবাদপত্র প্রকাশ মূলত মানুষের কাছে সমাজের বক্তব্য ও রাজনীতির বক্তব্যকে তুলে ধরার জন্য। প্রত্যেক পত্রিকার লক্ষ্যই হচ্ছে গণমানুষের কথা প্রকাশ করা। এ কাজ পরম যত্নে করেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তিনি শুধু পত্রিকা নয় চট্টগ্রামকেও লিডারশিপ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তিনি সমাজের সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাংবাদিকদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া বর্তমান সময়কে সাংবাদিকতায় ফিরিয়ে আনতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নৈতিক–আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের শূন্যতা কখনো পূরণ হবার নয়।
সাংবাদিক আবু সুফিয়ান বলেন, দৈনিক আজাদীর সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস একাকার। আর সে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে প্রফেসর খালেদ বেঁচে থাকবেন।
সন্ধ্যা ৭টায় ‘অধ্যাপক খালেদ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ’–এর পাঠ উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি বলেন, আমরা বাইরের কোনো লোক ধার করিনি। চট্টগ্রামের মানুষকে নিয়েই আজাদী। চট্টগ্রামবাসীদের কথা তুলে ধরাই আজাদীর লক্ষ্য। আজাদী সব মানুষের পত্রিকা। আজাদী ইজ দ্য প্রোডাক্ট অব প্রফেসর খালেদ। তিনি হুমায়ূন আহমেদ–এর উদ্ধৃতি টেনে বলেন, প্রফেসর খালেদ ছিলেন জীবন যাপনে সাধারণ মানুষ কিন্তু কাজ করেছেন অসাধারণ। তিনি কখনো কথার বরখেলাপ করতেন না। তিনি যাকে কথা দিতেন সেই কথা রক্ষা করতেন। তিনি আরও বলেন, আজকের এ অনুষ্ঠান সফল হবে যদি তাঁর চরিত্র থেকে আমরা কিছুটা ধারণ করি।
সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর রীতা দত্ত। আলোচনায় অংশ নেন কবি–প্রাবন্ধিক–নাট্যকার অভীক ওসমান। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন সাপ্তাহিক স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির। এসময় মঞ্চে ছিলেন চট্টগ্রাম একাডেমির পরিচালক নেছার আহমদ, দীপক বড়ুয়া, বিপুল বড়ুয়া, জাহাঙ্গীর মিঞা, এস এম আবদুল আজিজ, শারুদ নিজাম, রেজাউল করিম স্বপন, সুলতানা নুরজাহান রোজী, এস এম মোখলেসুর রহমান, বাসুদেব খাস্তগীর, ফারজানা রহমান শিমু। শুরুতে বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে উঠোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিশু শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক খালেদকে নিবেদিত কবিতা পাঠ করে অর্ধ শতাধিক কবি–ছড়াকার। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।