শিক্ষাদান অপরিহার্য এক সামাজিক পেশা। সাধারণ শিক্ষা যেমন সুনাগরিক তৈরীতে আবশ্যক তেমনি মান সম্মত চিকিৎসক তৈরীতে প্রয়োজন উন্নত ও সময়োপযোগী মেডিকেল শিক্ষা। এই শিক্ষার রূপকার ও বাস্তবায়নকারী হচ্ছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষকগণ। তেমন একজন আদর্শ শিক্ষক সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। তিনি ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিথযশা প্রফেসর। তার অধ্যাপনার বিষয় মেডিকেল বায়োকেমেষ্ট্রি তথা প্রাণ রসায়ন হলেও পুরো চিকিৎসা শাস্ত্রকেই তিনি তার শিক্ষাদানের বিষয় বস্তু হিসেবে নিয়েছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পদবী প্রফেসর হয়ে তিনি এই পদবীতে মহিমান্বিত হয়েছেন। ‘প্রফেসর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে যিনি প্রফেসর (Profess) অর্থাৎ ঘোষণা করেন। তিনি আকুন্ঠ চিত্তে ও স্পষ্টভাবে ঘোষনা করেন তাঁর জ্ঞান গরিমা ও নিজ বিষয়ের উপর বুৎপত্তি। একজন প্রফেসর হন তার বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি সর্বোচ্চ মানের একজন শিক্ষক। তিনি শিক্ষক হিসাবে পাঠদান করেন, গবেষক হিসেবে মৌলিক গবেষণা করেন– যার ফলাফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি তার ছাত্রদের একাডেমিক বিষয়ে ও গবেষণায় গাইড হিসাবে কাজ করেন। একজন প্রফেসর প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ডিন ও অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জনস্বার্থে রেডিও, টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা রাখেন। ‘প্রফেসর’ পদবী তার নামের অংশ হিসাবে স্বীকৃত। তা ১৮৩৭ সাল থেকেই।
এই আপ্ত বাক্যগুলো প্রয়াত অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি সেগুলো ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তার মেধা ও মনন দিয়ে। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। বিগত ১৯৮১ সালে তিনি তদানিন্তন আইপিজিএমআর (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) এর বায়োকেমেষ্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থাকাকালীন আমি সেই প্রতিষ্ঠানে এমবিবিএস ১ম বর্ষে ভর্তি হই। ঐ বছর মার্চে আমাদের ক্লাস শুরুর ২য় দিন উক্ত প্রতিষ্ঠানে বেসিক বিল্ডিং এর ৪র্থ তলায় বায়োকেমিষ্ট্রি বিভাগে শুভাগত স্যারের সাথে আমাদের সাক্ষাতের সুযোগ হয়। আমরা শুভাগত স্যারের রুমের সামনের করিডোরে পৌঁছি। করিডোর থেকে উনার রুমের নাম ফলক দৃশ্যমান। কিছুটা ব্যক্তিক্রমধর্মী নাম। আবার এই নামের শিক্ষকের সাথে ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হবু ডাক্তারদের সাক্ষাৎ। নামটা আমাদের স্বপ্ন ও উদ্দেশ্যে সাথে সঙ্গতিপূর্ণও বটে! আমাদের এক চিন্তাশীল সহপাঠীর মনে তা তাৎক্ষণিক রেখাপাত করে। সে সবার সামনে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে উনার রুমের অভিমুখে প্রসারিত করে নাটকীয় ভঙ্গিতে উচ্চারন করে উঠে– শুভাগত! সহপাঠী বন্ধুটির সরস উচ্চারণে আমিও নিজেকে ‘শুভাগত’ স্যারের রুমে শুভকর্মে অভ্যাগতি শিক্ষাগত জ্ঞান করি। আমরা সবাই উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। শুভ্রকান্তি, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনী, চশমা আবৃত তীক্ষ্ণ নেত্র যুগল। তিনি আমাদের স্বাগত জানান। এভাবে ক্লাস শুরু স্যারে সাথে। তিনি উল্লেখ করেন ‘তোমরা এই প্রতিষ্ঠানের আমাদের কনিষ্ঠ ছাত্র’। উল্লেখ্য, আমরা মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা ৫০ জন সেবার এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হই। প্রতিষ্ঠানের অন্যান্যরা সবাই স্নতোকোত্তর কোর্স যেমন, এফসিপিএস, এমফিল, ডিপ্লোমা ও অন্যান্য কোর্সের ছাত্র তারা অনেকটা পরিণত বয়সের। তারা পড়াশুনার পাশাপাশি পেশাগত, পারিবারিক ও সাংসারিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত। সেই অর্থে শুভাগত সারের সার্বক্ষণিক ছাত্র তখন কেবলই আমরাই। সেদিনের স্বাগত বক্তব্যে তিনি ‘ডাক্তার’ শব্দের উপর আলোকপাত করেন। তিনি উল্লেখ করেন ‘ডাক্তার’ (ইংরেজিতে ডক্টর) ল্যাটিন শব্দ। তার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘যিনি শিক্ষাদান করেন’। একজন চিকিৎসক মূলত একজন শিক্ষক। রোগী চিকিৎসার অন্যতম অংশ হচ্ছে রোগীর শিক্ষা। রোগীর শিক্ষাছাড়া শুধু ওষুধ লিখে কোন চিকিৎসক তার দায়িত্ব শেষ করলে তা রোগ নিরাময়ে কার্যকর হবে না। শুভাগত স্যারের প্রথম ক্লাসের সেই উক্তি এখনও প্রাসঙ্গিক। তিনি নিজেও তার বক্তৃতা, লেখনী ও প্রকাশনার মাধ্যমে এই রোগী শিক্ষাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন সকলের মাঝে। কথায় বলে, ‘first impression is the best impression‘ (প্রথম প্রভাবই সেরা প্রভাব)। উনার ক্ষেত্রে তাই প্রথম দিনে শুভাগত স্যারের মোহনীয় ব্যক্তিত্ব, ছাত্রদের মুগ্ধ করার যাদুকরী গুণ সুস্মরণবোধ, সরলঅথচ বলিষ্ট কন্ঠস্বর আমাদের মনে যে প্রভাব ফেলে তা অটুট থাকে পুরো ছাত্রজীবন জুড়ে; এমনকি পরবর্তী সময়েও। সেই আশির দশকে মেডিকেল শিক্ষা জীবনের প্রারম্ভে শুভাগত স্যারের এই উদ্ধুদ্ধকরণ আমাদের মেডিকেল শিক্ষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, তার প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছে এবং ভবিষ্যতে ভালো চিকিৎসক হওয়ার উৎসাহ যুগিয়েছে। পরবর্তী ক্লাসগুলোতেও তিনি একই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর ক্লাস শুধু পাঠ্য বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি এদেশের মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়ন, জনস্বাস্থের উন্নতি ও সুস্বাস্থ্যের বার্তা সর্বসাধারণে পৌঁছাতে সেই সময়ে ভাবিত হয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেছেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে বিভিন্ন বাংলা পরিভাষা তৈরী ও তার ব্যবহার বিষয়ে তিনি আমাদের আগ্রহী করে তুলেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয় তাই তা সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে তিনি তৎপর ছিলেন। তার অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে এমবিবিএস এর মেডিসিন পাঠ্য বই মেডিসিন এর বাংলা সংস্করণ করেন। বইটির বাংলা নামাকরণ “ডেভিডসন এর মেডিসিন ঃ মূলনীতি ও প্রয়োগ”। প্রয়াত শুভাগত স্যারেরই দেওয়া। তার পাশাপাশি তিনি জনগুরুত্ব সম্পন্ন বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখা শুরু করেন। তার এই উদ্যোগ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তা সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করতে ভূমিকা রাখে। অচিরেই তিনি এই দেশের স্বাস্থ্য সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি কেবল নিজে লিখে ক্ষান্ত হননি, অন্যদেরকেও লিখতে উৎসাহিত করেছেন। নব্বই এর দশকের শেষ দিকে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বায়োকেমেষ্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ও ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে দ্বিতীয়বার আমি উনার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক ফিজিশিয়ান হিসাবে কর্মরত। শুভাগত স্যারের সান্নিধ্যে আমি লেখালেখিতে উদ্ধুদ্ধ হই। তিনি তার সদয় উপদেশ ও নির্দেশনার গুলির মাধ্যমে আমাকে বিভিন্ন প্রকাশনায় পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৭ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহনের এক পর্যায়ে তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ২য় ব্যাচের এমবিবিএস এর ছাত্র। চাকুরী জীবনে নিয়োজিত ছিলেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। ২০০৪ সালে অবসর গ্রহনের পরও তিনি চিকিৎসা গবেষণা ও লেখালেখিতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বারডেম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। তিনি নিউইয়র্ক একাডেমী অব সায়েন্সের নির্বাচিত সদস্য এবং এদেশের স্নাতকোত্তর মেডিকেল শিক্ষার শীর্য প্রতিষ্ঠান বিসিপিএস এর সম্মানিত ফেলো। চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি শেরে বাংলা জাতীয় পুরষ্কার লাভ করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ৩৮ টা। আর বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশনা অগণিত। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বায়োকেমেষ্ট্রি, পুষ্টি ও মেডিকেল শিক্ষা,তিনি কল্প কাহিনী ও পরিবেশ বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত হন। সদা কর্মমুখর শুভাগত স্যার এক সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এই শারীরিক অবস্থায়ও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। তখনও তিনি তার মননশীল লেখনী অব্যাহত রাখেন। এদেশের গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে উনার চিন্তাধারা তখনও অব্যাহত থাকে। তাই ক্যান্সার নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘চিকিৎসা খাতে খরচ দারিদ্রের একটা বড় কারণ। সাধারণ মানুষের ক্যান্সারের টাকা কোথা থেকে আসবে? ক্যান্সার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এই ব্যাপারে একটা ফান্ড গঠন করা দরকার। সাধারণ মানুষের ক্যান্সারের চিকিৎসা সুলভে করতে পারলে আমাদের পূণ্য হবে।’ তিনি ক্যান্সার জয় করেন। কিন্তু ১৫ জানুয়ারী ভোরে আকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন।
পৃথিবীতে জন্ম মৃত্যু জাগ্রতিক নিয়মেই ঘটে। জন্মের পর মা বাবা ও নিকট আত্মীয়গণ নবজাতকের সুন্দর নামকরণ করেন। প্রায়শঃ দেখা যায় ব্যক্তি বিশেষের নামের সাথে জীবদশায় সাধিত কর্মের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ থাকেন এইক্ষেত্রে সক্ষমতার পরিচয় দেন। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। পরিবার পরিজন, ছাত্রছাত্রী ও দেশের আপাময় মানুষের শুভ কর্ম সম্পাদনে তার আগমন। তিনি দেশের মানুষের কাছে সুস্বাস্থ্যের শুভ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। ১৫ই জানুয়ারী বুধবার সকালে শুভক্ষণেই তার প্রত্যাগমন। সনাতন হিন্দুমতে বুধবার যাত্রা শুভ যাত্রা। এভাবে তাঁর বিদুষী ও সুসাহিত্যিক মাতা ড. মঞ্জুুশ্রী চৌধুরীর দেওয়া নামকে তিনি সার্থক ও মহিমান্বিত করেছেন তার কর্মের মাধ্যমে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।