অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান স্মরণে

অধ্যাপক মুহাম্মদ দিদারুল ইসলাম | রবিবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৬১ সনে চট্টগ্রামে সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর সরকারি কমার্স কলেজে ভর্তি হই। সেখানেই কাজী সামশুর রহমানের সাথে আমার পরিচয়। সময় অতিক্রান্তের সাথে আমাদের দুই জনের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন রচিত হয়। এইভাবে বি.কম. পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম.-এ চান্স না হওয়ায় অগত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি হই। প্রথমে গিয়ে উঠি আমার ফুফা চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের রাজশাহী শহরের ‘সাঁঝের মায়া’ বাসায়। সাথে উনার ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ুয়া মুহাম্মদ ইবনে এনাম ও অপরজন একজন ব্যাংকার। প্রথম বৎসর হলে সিট পাইনি। ফলে এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বাসে যাতায়াত। নীচের তলায় থাকতাম। বুয়া এসে রেঁধে দিয়ে যেত। বাজার করতে হত আমাদেরকে। ২৩ টাকায় দু’কেজি ওজনের পদ্মার ইলিশ। স্বাদ কাকে বলে! – না খেলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। পাঁচ টাকার ১০০টি আমের () ঝুড়িপ্রসঙ্গত: রাজশাহী তো আসলে আমের জন্য বিখ্যাত এই কথা সবাই জানে। ২য় বর্ষে এসে সিট পেলাম এস. এম. (শাহ্‌ মখদুম) হলে। কাজী সামশু পেল ‘লতিফ হলে’। প্রতি মাসে বাবা পাঠাতেন ১৫০/- টাকা। কাজী সামশুও অনুরূপ টাকা পেত। ১২/- টাকা টিউশন ফি, হলে অবস্থান, দু’বেলা খাইখরচ সহ ৪৫/-। প্রসঙ্গত তখন স্বর্ণের ভরি ৫০/- টাকা। হলের বাবুর্চি, বয়, কুমিল্লা, নোয়াখালীর হওয়ায় খেতে তেমন অসুবিধা হত না। হলে বসে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ ছাত্র বিবাহিত ও শ্বশুর বাড়ীরপয়সায় লেখাপড়া করে। যে পোস্টাল পিয়ন মানি অর্ডারে আমাদের জন্য প্রেরিত টাকা আন্‌ত। সে আমাদেরকে বলতো স্যার! আপনারা তো ধনীর ছেলে। এদিকে অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের ধারণা ছিলচট্টগ্রামের লোকেরা অত্যন্ত ধনী। সে কারণে দেখতাম সকাল, বিকেলের নাস্তা তারা করত না। সকাল৯ টার মধ্যে তখন হলে ভাত রেডি। তা খেয়ে সোজা ক্লাসে। বিকেলে মাগরিবের নামাযের পর ভাত খেয়েপড়াশুনা করে ঘুমিয়ে পড়ত। আমাদেরকে অভ্যাসবশত হলের ডাইনিং হলের চার ছয় আনায় চানাস্তা না হলে চলত না। এদিকে কাজী সামশু তার হলে ছাত্রলীগের একটি বলয় সৃষ্টি করে ফেলেছে। বিকেল হলে সুরম্য আম বাগানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় দলবল সহ চানাস্তা করতে যেত। বিল পরিশোধ করত সে নিজেমধ্যে মধ্যে আমি। এদিক ২১ ফেব্রুয়ারি আসলে তো কথাই নেই। দলবল ভারী হতে থাকে। আমি তো ছিলাম নিত্যসঙ্গী। আমরা নিজের পয়সায় ছোট পরিসরে ‘স্মরণিকা’ বের করতাম সেখানে তার ও আমার লেখা থাকত। তখন একটি মহল প্রচারনা চালাত এগুলো সব আমেরিকান সি.আই.-এর টাকা। এদিকে হলের সংসদ নির্বাচন আসলে কাজী সামশু বিপুল ভোটে ‘লতিফ হলে’র জি. এস. নির্বাচিত হয়। এভাবে সময় অতিক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালে আমি এম. কম, কাজী সামশু অর্থনীতিতে এম. . পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। তখন সরকারি কলেজে থেকে বেসরকারি কলেজে বেতন বেশী ছিল।

এদিকে দূরত্বের কারণে আমার অপর আত্মীয় রাউজানের ডা: ফরিদ আহমদের (মরহুম) নানার সুপারিশে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে (বর্তমানে সরকারি) কলেজে চান্স পেয়ে যাই। কিন্তু তখনকার সময়ের জাদরেল অধ্যক্ষ মরহুম রেজাউল করিম চৌধুরী ছাহেব শর্ত দিয়ে বসেনএক বৎসর বিনা বেতনে থাকতে হবে। আমি যৌক্তিক কারণে শর্ত মানতে রাজী ছিলাম না বলে সেখানে যোগদান করিনি। বাবা রিয়াজউদ্দীন বাজারে হার্ডওয়ারের ব্যবসায়ী ছিলেন বিধায় আমার কলেজে যোগদান ভালোভাবে গ্রহণ করেন নি। কাজী সামশু নন্দনকানন ইশ্বরনন্দী লেনে ভাড়া বাসায় থেকে নানা ধরনের ব্যবসাবাণিজ্যে নিজকে নিয়োজিত রাখে। এরি মধ্যে ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১২০ নং আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগের অফিস। যুদ্ধ চলাকালীন আমিও মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করতাম। একদিন পাক আর্মি তাকে সহ আরও কয়েকজনকে ধরে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। যখন মেজর অফিসারের সামনে তাদের হাজির করা হয় অফিসার তাদের পই পই করে চেক করার সময় তার চোখ পড়ে কাজী সামশু’র দিকে। সবাই দেখেছেন কাজী সামশুর ডান হাত একটি রোগের অপারেশনের কারণে লম্বায় ছোটবাম হাতে সব কাজ করত। বলা বাহুল্য সেই হাতে সে তাদের নিজস্ব গাড়ি চালাত। গাড়িতে তার সাথে উঠলে সে এত জোরে গাড়ি চালাত যেযদি বলি স্পীড কমাও। আমাকে ধমক দিয়ে বলত্‌। সহ্য না হলে গাড়ি থেকে নেমে যানীরব হয়ে যেতাম।

অফিসার তাকে চিনতে পারেন। পাকিস্তান আমলে বহু উর্দুভাষী ছাত্র আমাদের সাথে কমার্স কলেজের ছাত্র ছিল। এক বাংলা ছাড়া সব বিষয় ছিল ইংরেজিতে। তাকে আমিও চিনতাম সহপাঠী হিসেবে, কিন্তু নামটি ভুলে গেছি। সে খুব কড়া সূরে সিপাহীদের বললএ কাকে ধরে এনেছএতো মাজুর হ্যায়তাকে ছেড়ে দাও। এইভাবে আল্লাহ্‌র বিশেষ রহমতে সে বেঁচে যায়। বাকীদের ভাগ্য অজানা। এরপর কাজী সামশু শহরকে আর নিরাপদ না দেখে রাউজানের বাড়িতে চলে যায়সেখানেও রাজাকারআলবদর বাহিনীর অপতৎপরতা দেখেকিছু বন্ধুবান্ধব ও অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ ফটিকছড়ি হয়ে আগরতলা পৌঁছে যায়। সেখানে সে শরণার্থীদের তত্ত্বাবধানের জন্য লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। বেশ কিছুদ্দিন পর ত্রিপুরা ঘুরে কোলকাতা পৌঁছে। সেখানে স্বাধীনতা পক্ষের সরকারের একই কাজে থেকে দায়িত্ব পালন করেসুযোগে ভারতের প্রায় শহর ভ্রমণ করে আগরতলা থাকাকালিন বিভিন্ন জনের মাধ্যমে আমাকে চলে আসার জন্য খবর দিতে থাকেকিন্তু পাক বাহিনী কর্তৃক প্রায় পথ রুদ্ধ করে ফেলায়চেষ্টা করেও যেতে পারিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজী সামশু দেশে ফিরে আমার বাসায় উঠে। আমরা দুইজন একই বিছানায় ঘুমাতাম। সকালে নাস্তা করে সে চলে যেত। রাতে আস্‌ত কোনদিন খেতকোনদিন খেত না। পরে শুনলাম সে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কোম্পানীর শ্রমিক লীগ সংগঠনের নেতা হিসেবে কাজ করছে। এইভাবে প্রায় ছয়মাস পর দিদার মার্কেটের পেছনে মামা আবদুল্লাহ্‌ আল্‌ হারুন এম.পি. সাহেবের বাসার সামনে একটি বাসা ভাড়া করে। সেখানে প্রায়ই যেতামদেখতাম বিভিন্ন মিল, ফ্যাক্টরি শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও মালিক পক্ষের অগণিত মানুষের আনাগোনা। নেতা গাড়ি চাইলেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। অত্যন্ত ব্যস্ত। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস– ‘৭৫ পটপরিবর্তনে সবকিছু ওলট পালট। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুসহ (দুই কন্যা ব্যতীত) তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্রসহ শিশু রাসেল ও পুত্র বধূদের নির্মমভাবে হত্যা করে। হায়রে মানুষ! তারা যদি জানত রোজ কেয়ামতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইজ্জত প্রথম দিকে বিচার করবেন মানুষ হত্যাকারীদের এবং দোযখে নিক্ষিপ্ত করবেন। কাজী সামশু এরি মধ্যে কি একটা ব্যবসা ধরতে গিয়ে বিরাট মার খেয়ে যায়। এতে তার আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।

এই অবস্থায় সে প্রথমে কধুরখীল জলিল আম্বিয়া কলেজে পরে মুজাফ্‌রাবাদ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। এরিমধ্যে সে বিয়ে করে১ ছেলে ও ২ মেয়ে। ছেলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় থাকে। দুই মেয়ে মালয়েশিয়ায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হতে পি.এইচ.ডি করতে পাঠরত। ১ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ১৯৮২ সালে সে আমাকে বলুয়ার দিঘির খানকা শরীফে নিয়ে যায়। আমি হুজুর কেবলা তৈয়ব শাহ্‌ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির হাত মোবারকে বায়াত গ্রহণ করি। এর ফলে আমার জীবনের বহু কিছুর পরিবর্তন আসে। হুজুর কেবলা বলতেন ‘বাতিলছে দূর রহো। উছকা সাথ মোকাবেলা করো।’ আমরা কিকেউ মানছি তাঁর প্রদত্ত উপদেশবাণী। আমি প্রায়ই সকালের নাস্তা নিয়ে আসতাম। একটু অসুবিধা হতো শীতের সময়। আমার স্ত্রী পরিপাটি করে টিফিন কেরিয়ারে ঠিক করে দিত তা’ নিয়ে শীতের রাত্রির শেষ ভাগে আসকার দিঘির পাড় থেকে বলুয়ার দিঘি। একদিন এ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি রিকসার জন্য। শীত বেশী পড়ছিলআর ভাবছি হায়রে এ সময় যদি একটি রিকসা পেতাম। ১০ মিনিট পর একটি রিকসা আসতে দেখলামযাত্রী হিসাবে পায়জামাপাঞ্জাবীমাথায় টুপি পরিহিত এক ভদ্রলোক। কাছে আসতেই হাঁক দিলামভাই! আপনি কি বলুয়ার দিঘি খানকা শরীফ যাচ্ছেন। যদি যান আমাকে একটু সাহায্য করুন। ভদ্রলোক রিকসা থামিয়ে বললেনআসুন। আল্লাহ্‌র কাছে শুকরিয়া জানালাম। শুধু এ’টা নয়খানকা শরীফে যাওয়ার সময় বিশেষ করে সকালের ফরজ নামাজে যাওয়ার সময় মাথায় অনেক কিছু চিন্তা আসত। হুজুর কেবলা ফজরের নামায শেষে কোরআন থেকে আয়াত তেলোয়াত করে তকরির করতেন। নঈমী সাব হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর তরজুমা করতেন। প্রায়ই দেখতামযা কিছু মাথায় চিন্তা করতেছিলামহুজুর কেবলা সেই বিষয়ের উপর তকরির করছেন। মনটা আনন্দে ভরে যেত। এরপরই তিনি নাস্তায় শরীক হয়ে আরামে চলে যেতেন। (আগামীকাল সমাপ্য)

লেখক : জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসার প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধনিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়েতে অসুস্থ সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি