জ্যোতির্ময়ী দৃঢ়চেতা অনন্য সাধারণ এক নারী ছিলেন অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আখতার হানিফ। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত এই নারীর খুব কাছে যাওয়া বা সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়নি। হয়তোবা বয়সের ব্যবধানের কারণে। তবে আমার নানা সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মোফখখর, আম্মা সাহিত্যিক মমতাজ সবুর এর সাথে রওশন আপার বাবা বিশিষ্ট সমাজসেবক দানবীর শ্রদ্ধেয় মরহুম বাদশা মিয়ার জানাশুনা সেই সাথে আপার এক ফুফু আমাদের প্রতিবেশী খালাম্মা (এডভোকেট মিসেস গফুর) এর কারণে আম্মার সাথে শৈশবে কৈশোরে উনাদের বাসায় যাওয়া ও আপাকে দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার বহুবার হয়েছে। আম্মার কাছে আমার এই গল্প বহুবার শোনা। মুসলিম নারীদের অন্তঃপুরের জীবন নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত আম্মার একটা লেখা পড়ে রওশন আপার বাবা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন শিক্ষায় ও চাকরিতে হিন্দু নারীদের তুলনায় মুসলমান নারীদের পিছিয়ে পড়া নিয়ে। পরবর্তীতে এই বড় মাপের শিক্ষা সেবকের উদ্যোগে ১৯৫৭ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সেন্ট্রাল গার্লস কলেজ’, পরবর্তীতে যা ‘চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ’ নামে পরিচিত হয়। আজকের চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত অনেক কলেজ শুরুর পেছনে শিক্ষার অগ্রদূত দানবীর বাদশা মিয়া চৌধুরীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
১৯৮৮ সালে মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট এর পরপর এনায়েত বাজারস্থ মহিলা কলেজ চট্টগ্রামে আমার চাকরি হলো। তৎকালীন কলেজের অধ্যক্ষ নিলুফার খানম আপা যখন শুনলেন, ভার্সিটি লাইফে আমি বি.এন.সি.সি করতাম, তখন তিনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন কলেজের বি.এন.সি.সি শাখাটির দেখভাল করার। সিনিয়র আপা অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমের সাথে এই দায়িত্বে ছিলাম বেশ কিছুদিন। তখন সম্ভবত সরকারি মহিলা কলেজ বি.এন.সি.সি কর্ণফুলী রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম ৩.ব্যাটালিয়নের হেডকোয়ার্টার। আপাকে কাছ থেকে দেখলাম। তিনি তখন বি.এন.সি.সিতে মেজর পদে কমান্ডিং অফিসার। একদিন সকালবেলা বি.এন.সি.সির শীতকালীন ক্যাম্প উপলক্ষ্যে কোনও এক কাজে সরকারি মহিলা কলেজে আনোয়ার আপার সাথে গেছি। আপাকে দেখলাম প্রশাসনিক ভবনের সামনে গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নামছেন। নামতে নামতে ডিসিপ্লিন ভঙের কারণে কোন এক কর্মচারীকে বকাঝকা করছেন। আমার ভেতর থেকে তখনো ছাত্রী–ছাত্রী গন্ধ যায়নি। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হলো। মনে হলো এই দুর্দণ্ড প্রতাপশালী নারী এই বুঝি আমাকেও খুব করে বকা একটা লাগাবেন। পরবর্তীতে সরকারি ও বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষক কর্মকর্তা হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল সুবিদিত।
২০১২ সালে মহিলা কলেজ চট্টগ্রামে প্রাক্তন ছাত্রী পরিষদের প্রথম পুনর্মিলনী হল। সেই সময় সবে আমি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছি। প্রশাসনিক দায়িত্বে এসে জানতে পারলাম কীভাবে আমাদের কলেজটি আপার বাবা শ্রদ্ধেয় মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরী, আপার খালু মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানিয়ে আপা দৈনিক আজাদীতে লিখলেন। অনুষ্ঠানের দিন খুশি হয়ে আপা অনেকটা সময় রইলেন আমাদের সাথে। আপা তাঁর বাবার অনুরোধে অল্প কিছুকাল বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের কলেজে অর্থনীতির ক্লাস নিয়েছিলেন। সেই অজানা তথ্যটিও আমরা সেদিন জানতে পেরেছিলাম।
আপার সাথে গভীর সান্নিধ্যে এলাম ২০১৩ সালে। আমার আব্বা এডভোকেট আবদুস সবুর ইন্তেকাল করেছেন ২০০৯ সালে। ৩ বছর পর ২০১২ সালে আম্মাও চলে গেলেন। তখন আমরা ভাই বোনরা নিঃস্ব রিক্ত প্রায়। বিষাদ এবং হতাশায় ভুগছি। তখন একদিন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই আমার কলেজে এলেন। বড় ভাইয়ের স্নেহে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমাদের পারিবারিক ইতিহাস লেখার জন্য গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী খানখানাবাদে গেলেন। আমার নানার বাড়ি চান্দগাঁও মৌলবি বাড়ি ও পটিয়াস্থ আদি বাড়িতে গিয়ে দিনের পর দিন তথ্য সংগ্রহ করলেন। মজনু ভাইয়ের এই উদ্যোগ ও সিরাজুল ইসলাম মানিক ভাইয়ের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘মমতাজ সবুর ও আবদুস সবুর স্মৃতি পরিষদ’। মজনু ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণায়, সাখাওয়াত হোসেন মজনু ও মর্জিনা আখতার এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো ‘মমতাজ সবুর স্মারক গ্রন্থ’ ও ‘মমতাজ সবুর রচনাসমগ্র’। অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আখতার হানিফ আপা হলেন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। রওশন আপার তখন লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে। অপারেশনের জন্য ঢাকায় যাবেন। তার আগে আমার কলেজে এলেন, ’মমতাজ সবুর ও আবদুস সবূর স্মৃতি পরিষদে’র প্রথম সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজন পরিকল্পনায়। আমি মনে মনে কিছুটা শংকিত, আপা কি পারবেন! আপা পারলেন। অসুস্থ শরীর কিন্তু তার লেশ মাত্র ছিল না তাঁর আচরণে কণ্ঠে। প্রতিটি মিটিংয়ে তিনি হাজির হতেন। হাসি, গল্পে, আড্ডায় আমাদের উৎসাহ যোগাতেন। অনুষ্ঠানের দিন সভাপতির মতো অশেষ ধৈর্য ও সময় সাপেক্ষ দায়িত্বও তিনি পালন করলেন হাসিমুখে।
২০১৪ তে আপার আবার ব্রেস্ট ক্যান্সার অপারেশন হয়েছে চট্টগ্রামের সি.এস. সি আর এ। দেখতে গেলাম একদিন। মোটেও ভেঙে পড়া কোন নারী ছিলেন না আপা। অসুখের বিরুদ্ধে অকুতোভয় এক আপসহীন রমণী। শুধু বললেন, ‘যতদিন কাজে ছিলাম কোনও অসুখ ছিল না আমার, যেই কাজ থেকে অবসর নিলাম, অসুখ বিসুখ শরীরটা দখল করে নিলো’।
২০১৫ এর মার্চে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তন, প্রেসক্লাবে ‘মমতাজ সবুর আবদুস সবুর স্মৃতি পরিষদে’র দ্বিতীয় সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানেও আপা এলেন। প্রবল ধৈর্য ও উৎসাহ নিয়ে সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করলেন। প্রেরণা ও সাহস জোগালেন আমাদের প্রথমবারের মতোই। এর আগে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রতিটি মিটিংয়ে হাজির হলেন। শুধু বলতেন, ‘আমাকে কিন্তু গাড়িতে আনতে ও পৌঁছাতে হবে। হাঁটতে আমার কষ্ট হয়। যা করবার নিচ তলায় করো। সিঁড়ি বাইতে পারবো না’।
অনুষ্ঠান শেষে প্রেসক্লাবের মিলনায়তন থেকে আপাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলাম রাস্তায়। তারপর গাড়িতে তুলে দিতে দিতে বললাম, ‘আপা আপনার এত কাজ এত স্মৃতি আপনি লিখবেন’।
আপা বললেন, ‘লিখতাম তো আমি ছোটবেলায়। কবিতা লিখতাম। তারপর বাবার উপর অভিমান করে আর লিখলাম না’।
আমি আপার হাতে চাপ দিয়ে বললাম, ‘আপা লিখবেন। না হয় আগামী প্রজন্ম জানবে কী করে কাদের হাত ধরে চট্টগ্রাম শহরটি গড়ে উঠেছে’।
আপা হাসলেন। আপাকে বললাম, ‘আপা আপনাকে আমি আমাদের কলেজ ফাংশানে অতিথি করে আনব। আপা আপনি কি আসবেন’?
আপা হাসলেন, ‘আসবো না আবার’।
সেই ছিল আপার সাথে আমার শেষ দেখা ও সংলাপ।
তারপর আপার পার্সিভাল হিলের বাসায় গেলাম এক সকালে নিথর আপাকে দেখতে। যেন এক বর্ণাঢ্যময় সময়ের অবসান দেখতে গেলাম।
আমি শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আখতার হানিফ আপার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ পাকআপাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন আমিন ।
লেখক: কবি–গল্পকার, প্রাক্তন অধ্যক্ষ,
এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ।